ASANSOL

৬০ জন ছাত্রের ভবিষ্যতে পড়ার অনিশ্চয়তা দূর করে দিল আসানসোল প্রগতি

বেঙ্গল মিরর, আসানসোল: মাত্র ক’দিন আগেই মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার  ভাল ফলকরেও চার দৃষ্টিহীন ছাত্রের ভবিষ্যতে  পড়ার অনিশ্চয়তা  দূর করে দিল আসানসোল প্রগতি নামে একটি  সামাজিক সংগঠন  এই সময় পত্রিকা তে খবর প্রকাশের সাথে সাথেই। ১৫ ই আগস্ট আসানসোল প্রগতি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে রবীন্দ্রভবনে দৃষ্টিহীন চার ছাত্রছাত্রীসহ ষাট জন ছাত্রছাত্রীর হাতে আর্থিক সাহায্য বাবদ চেক তুলে দেয়া হলো ।সেইসঙ্গে সংগঠনের পক্ষে পিন্টু ভট্টাচার্য ঘোষণা করলেন আমরা শুধু ওই দৃষ্টিহীন চার ছাত্রই- নয় এই ষাট জনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা চালানোর যে অর্থ খরচ হবে তা বহন করব। এদিন দৃষ্টিহীন ছাত্রদের দশ হাজার টাকার একটি করে চেক এবং বাকি ৫৬ জনকে পাঁচ হাজার টাকার একটি করে চেক দেওয়া হয়। তাছাড়াও আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান সোমাত্মানন্দ মহারাজ এর হাতে দশ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেয়া হয় সেখানকার সাহায্যের জন্য।

আসানসোল ব্রেইল একাডেমি থেকে ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা টুকু নিয়ে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড একাডেমিতে পড়তে চলে গিয়েছিলেন এই শিল্পাঞ্চলে চারজন। এদের মধ্যে বশিষ্ঠ সিং যার জীবনটাই একটা ছবির মত।  বছর আটেক বয়সে তার বাবা তার মাকে এবং তার দিদিকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হন এবং বশিষ্ঠকে স্থানীয় একটি নদীর জলে ভাসিয়ে দেন ।সেখান থেকেই কোনমতে উঠে সারা রাত্রি সে পাশের জঙ্গলে কাটায় ।পরের দিন সকালবেলা তাকে তার পিসির। কুলটির বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় এবং সেখান থেকে সে পড়াশোনা চালানো শুরু করে  আসানসোলের ব্রেইল একাডেমিতে। পরে নরেন্দ্রপুরের ওই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এবছর বশিষ্ঠ  এই স্কুল থেকে ৫৯৯  নম্বর পেইড মাধ্যমিকে ভালো ফল করেছে।।জুডো তে সে একাধিক স্বর্ণ পদক পেয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাকার বাড়ি নিতুরিয়া এলাকাতেই থাকে।  স্বাভাবিকভাবেই তার পড়ার  দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলো আসানসোল প্রগতি ।একইভাবে অভিজিৎ গড়াই  ৬৩২ পেয়ে এই স্কুল থেকেই এবার  ভালো ফল করেছে এবং জুডোতে   পদক পেয়েছে। তাছাড়াও অরকেসটার এ একাধিক বাদ্যযন্ত্র  সে বাজাতে ওস্তাদ।  অভিজিতের বাবা বানেশ্বর গড়াই চপ ঘুগনি বিক্রি করে কোনমতে সংসার চালাত বার্নপুরে।  লকডাউনে সেটাও খুব ভালো করে চলছে না। তার বাড়িতে তার দাদা আঠের মাস ধরে অসুস্থ বিছানায়।দিদি আসানসোলের একটি কলেজের ছাত্রী। অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্যে সংসার চলছে ।ফলে আগামীদিনে তার পড়া হবে সে ভাবতেই পারেনি। যখন আসানসোল প্রগতি তার হাতে দশ হাজার টাকার চেক তুলে দিলো তারপর তার বাবা এবং মা প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বাবা বানেশ্বর গড়াই বললেন আমরা ভাবতেই পারছিনা যে আমাদের ছেলের পড়াশোনার সারা জীবনের দায়িত্ব নিল এমন একটা সংগঠন । তার মা বললেন এই সময় কাগজে হয়তো এমন  ভাবে খবর যদি না প্রকাশিত হতো তাহলে এই সুযোগটাই আসত না। ঐ পত্রিকাকে অনেক ধন্যবাদ । একইভাবে এ বছরেই মাধ্যমিকে ৬১৭ পেয়ে ভালো ফল করেছে মন্টু বাউরী। মন্টু তিন তিনবার জুডোতে স্বর্ণপদক পেয়েছে এবং সে দক্ষিণ এশিয়ায় জুজুৎসু চ্যাম্পিয়ন। নারেন্দ্রাপুরের ঐ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন আধার কার্ড না থাকায় এবং পাসপোর্ট না হওয়ায় তাকে আমরা লন্ডনে কমনওয়েলথে পাঠাতে পারিনি।  পড়াশোনার সাথে সাথে এমন এই খেলায় ভালো ছাত্র খুবই কম মিলবে হয়ত।

এই বিদ্যালয় থেকেই এবার উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় ৯৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে অত্যন্ত ভালো ফল করেছেন অমিত যাদব। অমিতের বাবা একটি স্কুলের ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালায়। অমিত আগামী দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। কেননা সে জানিয়েছে যাদবপুরে ব্রেইল এর লাইব্রেরি এই রাজ্যে সবচেয়ে ভালো।  এছাড়াও এখানে তাদের সিনিয়র কয়েকজন দাদাও আছেন। এখানে পড়লে জীবনে অনেক দূর অব্দি এগোনো যাবে। যদি সেখানে সুযোগ না পায় তাহলে সে শান্তিনিকেতনে পড়বে বলে জানিয়েছে। কিন্তু অমিতের পড়ার খরচ বহন করার মতো ক্ষমতা তার বাবার ছিল না ।অমিত নিজেই বারবার এই সময় কে বলেছিল কেউ যদি তাকে পড়ায় সাহায্য করে তাহলে সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। এক্ষেত্রেও আসানসোল প্রগতি এগিয়ে এসেছে এবং অমিত জীবনের পড়াশোনা করার জন্য যে অর্থসাহায্য দরকার তারা তা দেবে বলে জানিয়েছেন ওই সংস্থার কর্মকর্তারা। এছাড়াও অমিতের নিজের একটি আবেদন ছিল তার একটা ল্যাপটপের। সেক্ষেত্রে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন এই সংস্থা বা অন্য কোন সংস্থা যদি আমার কাছে আবেদন করে তাহলে আমরা নিশ্চয়ই সেটা বোর্ড মিটিংয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব ।অমিত জুডোতেও  জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। 

নরেন্দ্রপুরের ওই বিদ্যালয়ের প্রধান বিশ্বজিৎ ঘোষ রবিবার জানান নম্বরের ভিত্তিতে আমাদের এখান থেকে মাধ্যমিকে পাস করা বশিষ্ট, অভিজিৎ এবং মন্টুকে আমরা এখানেই একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করতেপারছি এবং আগামী সপ্তাহ থেকেই ফোনের মাধ্যমে আমরা ক্লাস শুরু করব ।তিনি বলেন আসানসোল প্রগতি ওদের সহ অন্যদের পড়ার জন্য  যে কাজ করল তার জন্য এত দূর থেকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা তাদের জন্য রইল। তা না হলে হয়তো এই ছেলেগুলোর মাঝপথেই পড়া থেকে হারিয়ে যেত। আর আমি দুবছর ধরেই দেখছি আমাদের এই দৃষ্টিহীন ছাত্রদের জন্য এই সময় যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে তার জন্য তাদের অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

এই অনুষ্ঠানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল চোখে পড়ার মতো ।আট বছর আগে সনজিৎ রায় এবং অভিজিত দে এই দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে পড়ার জন্য আর্থিক খরচ বহন করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। আসানসোল প্রগতি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের পড়াশোনা শেষে সঞ্জিত এ বছরেই পয়লা জুলাই পুরুলিয়ার পোস্টমাস্টার পদে চাকরি পেয়েছে এবং অভিজিৎ গত বছর নভেম্বরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কলকাতায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাকরি পেয়েছে। এই দুজনে ১৫ ই আগস্ট এর এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন আমরা হয়তো আজকে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি তা আসানসোল প্রগতির জন্য। তাই আমরা আজকেই ঘোষণা করছি যতদিন বাচবো প্রতিবছর আমরা একজন ছাত্রীর দায়িত্ব নেব । যারা এখান থেকেই সুযোগ পাচ্ছেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা নিজেরা যখন প্রতিষ্ঠিত হবেন তারা অন্তত কিছু মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন।

 এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের আসানসোলের প্রধান সোমাত্মানন্দ জি মহারাজ এবং দিব্যস্বরূপানন্দ জি মহারাজ দুজনেই বলেন সাধারণ মানুষের কে নিয়ে এমন একটা সংগঠন শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করছে তাই নয় আমরা জানি এরা যেসব গরিব মানুষ টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না তাদের অনেকের পাশে সারা বছর ধরে দাঁড়িয়েছেন। একাধিক রক্তদান শিবির তারা করছেন এবং অনেককে আরো অন্যান্য ভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। স্বামী বিবেকানন্দের নামে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট করে খেলাধুলাতেও এরা উৎসাহ যোগান। আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনকেও গত কয়েক বছর ধরে এই বিশেষ দিনটিতে তারা আর্থিক সাহায্য করে আসছেন। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ ।আসানসোলের বিধায়ক ও  এ ডি ডি এর চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আসানসোল পুরসভার চেয়ারম্যান অমরনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন ২০১২ থেকেইএই সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে আজ মনে হয় আসানসোল প্রগতি দুস্থ গরিব এবং সংকটাপন্ন মানুষের সবচেয়ে বড়  পারিবারিক বন্ধু।

এই অনুষ্ঠানের শেষে দেখা গেল আসানসোল স্টেডিয়ামের যিনি মাঠসহ স্টেডিয়ামে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সেই দুস্থ হারান নস্কর কুড়ি হাজার টাকার একটি চেক নিয়ে বারবার চোখের জল মুচছেন। হারান বাবুর বাড়ি ক্যানিংয়ে। আম্ফানে তার ঘর একেবারেই ভেঙে চুরমার ।সেটা সারাতে ৩৫০০০টাকা মত দরকার। এই সংস্থা তাকে কুড়ি হাজার টাকা তুলে দিয়ে পাশে দাঁড়াল। ১৯৯৭ এর আগে তিনি ইডেনের মাঠে কাজ করতেন। এই অনুষ্ঠানে আরো দুই অতিথি ছিলেন সাংবাদিক ও সমাজ কর্মী বিশ্বদেব ভট্টাচার্য ও প্রদীপ ঠাকুর।তারা দুজনেই এই উদ্যোগের প্রসংসা করেন।ওই চার দৃষ্টিহীন ছাত্রের জীবন তুলে ধরেন বিশ্বদেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *