আবার ধস নামলো বরাকরে, ৫ বাড়িতে ফাটল
তলিয় গিয়েও প্রাণে বাঁচলো এক যুবক
বেঙ্গল মিরর, রাজা বন্দোপাধ্যায়, আসানসোল, ৩ ফেব্রুয়ারিঃ আবার ধস নামলো আসানসোলের কুলটির বরাকরে। বিসিসিএলের মধ্যে থাকা বরাকরের আরাডাঙার নবিনগর এলাকায় বুধবার সকালে এই ধসের ঘটনায় অন্ততঃ পাঁচটি বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। ধসে ভেঙ্গে যায় গোটা একটি বাড়ি। এদিনের এই ঘটনার জেরে গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভেঙ্গে মাটিতে প্রায় তলিয়ে যাওয়া একটি বাড়ির প্রায় ১৫ ফুট নিচে থেকে বেঁচে ফিরে আসে এক যুবক। আতঙ্কে বাড়িছাড়া সবকটি বাড়ির পরিবারের সদস্যরা।
শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এই ঘটনার পরে দাবি করা হয়েছে, কয়লাখনি জাতীয়করণের আগে এই এলাকায় কোম্পানি আমলে কয়লা তোলার পরে মাটির তলা ভরাট না হওয়ার জন্যই এইভাবে বারবার ধস নামছে। এই এলাকা রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা উৎপাদনকারী সংস্থা ভারত কোকিং কোল লিমিটেড বা বিসিসিএলের ১২ নং এরিয়া চাঁচ ভিক্টোরিয়ার।
এদিন ধসের ঘটনার খবর পেয়ে কুলটির বিধায়ক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল পুরনিগমের পুর প্রশাসক বোর্ডের সদস্য দিব্যেন্দু ভগৎ, প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র তবস্সুম আরা ও প্রাক্তন কাউন্সিলর পাপ্পু সিং এলাকায় আসেন। তবস্সুম আরা ও পাপ্পু সিং বিসিসিএলের জেনারেল ম্যানেজার সিদ্ধার্থ দাসের সঙ্গে দেখা করে তাকে গোটা বিষয়টি বলে ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িগুলির পরিবারের সদস্যদের অবিলম্বে বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দাবি জানান। জেনারেল ম্যানেজার সিদ্ধার্থ দাস সঙ্গে সঙ্গে এলাকায়ত আসেন।
তিনি আপাততঃ ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি পরিবারের সদস্যদের খনির আবাসনের থাকার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও দাবি করা হয়, এই এলাকায় ৩০টির মতো বাড়ি যেকোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে । তাই সবাইকেই অস্থায়ীভাবে বিসিসিএল কর্তৃপক্ষ এলাকা থেকে সরিয়ে অন্যত্র রাখার ব্যবস্থা করুক।
বরাকরের আরাডাঙার নবিনগরে গলির মধ্যে থাকা বাড়িগুলির মধ্যে একটি বাড়িতে থাকেন রুকসানা খাতুন স্বামী তাসনিম খান ও ছেলে শাহনওয়াজ খান। রুকসানা খাতুন বলেন, এদিন সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ বাড়ির সামনের গলিতে জল নেওয়ার জন্য কলের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎই ভয়ঙ্কর একটা আওয়াজ শুনতে পাই। দেখি বাড়ির সামনে ফাটল শুরু হয়েছে । সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে শুয়ে থাকা আমার ছেলে রাজা ওরফে শাহনওয়াজকে চিৎকার করে বলি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে। সে মোবাইল নিয়ে বেরোচ্ছি বলে সেই মোবাইল আনতে যেতেই তার গোটা ঘরটি মাটির নীচে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট ঢুকে যায়। শাহনওয়াজও বাড়ির সঙ্গে তলিয়ে যায়। তা দেখে রুকসানা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুরু করেন। তা শুনে রুকসানার স্বামী ও পাশের বাড়ির নিশাদ খান দৌড়ে এসে বাঁশ সেই গর্তে ঢুকিয়ে শাহনওয়াজকে উপরে উঠে আসতে বলেন। সেই বাঁশ ধরে সে কোনমতে সেই গর্ত থেকে উপরে উঠে এসে নিজের প্রাণে বাঁচায়।
যদিও বাড়িতে থাকা মোবাইল, ঘরে রাখা বাসনপত্র সহ অন্যান্য জিনিস মাটির নিচে তলিয়ে চাপা পড়ে যায়। সেগুলো তারা আর বার করে আনতে পারেননি।
শাহনওয়াজ বলেন, গত দুদিন ধরে ঘরের ছাদের অ্যাসবেস্টার বদলানোর কাজ হচ্ছিল। পাশাপাশি ঘরের সামনে একটা পাঁচিল তোলাও শুরু হয়েছে কাল থেকে। মাস দুয়েক পরেই তার বিয়ের দিন ঠিক ছিল বলে সে আরো বলে। শুধু তার বাড়ি নয়, এদিন এলাকায় গিয়ে দেখা গেল একটি ঘর ভেঙে যেমন মাটির তলায় ঢুকে গেছে। অন্যদিকের ঘরটি ভেঙে ত্রিভুজের মতো আকার নিয়েছে। শাহনওয়াজের পাশের দোতলা বাড়িটিতেও এদিনের ধসে ফাটল ধরেছে ।বিদ্যুতের তার খুলে ঝুলে রয়েছে । এইসব বাড়িতেই মহঃ আরমান , মহঃ জাকির , মহঃ ছোটু, ও মহঃ বেচন পরিবার নিয়ে থাকতেন। এদিন কোনমতে তারা সবাই প্রাণী বেঁচেছেন। সবাই নিজেদের বাড়ির ভেতরে থাকা জিনিসপত্র বার মাস এনে পাড়ার একটি ঘরে রেখেছেন। এখন তারা সেইসব জিনিসপত্র নিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিধায়ক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় বলেন, এর আগেও বরাকরের স্টেশন রোডে ধস নেমে ছিল। এরজন্য বিসিসিএল কর্তৃপক্ষ দায়ী। খনির নিচে ফাঁকা জায়গায় যেভাবে বালি ভরাট করার দরকার তারা তা করেননি। এখন যদি ঠিকমতো বালি ভরাট না করা হয় তাহলে অন্যান্য সব বাড়িগুলোও ধসে তলিয়ে যাবে।
বিসিসিএলের জেনারেল ম্যানেজার সিদ্ধার্থ দাস বলেন, ২০২০ সালে সর্বশেষ বরাকরের ধ্বস কবলিত এলাকা গুলি নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। দীর্ঘ দুই দশক আগে এই এলাকাটিকে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করে নির্মাণ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। তবে এই ঘটনার পরে মানবিক কারণে ক্ষতিগ্রস্থদের পাঁচটি ঘর দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। দ্রুত তা করা হবে।
এদিনের ধসের পরে গোটা এলাকাটি পুলিশ চারিদিকে ব্যারিকেড করে দেয়। যদিও খবর পেয়ে অনেক মানুষ ধসে যাওয়া বাড়িগুলো দেখতে আসছেন। কিন্তু যাদের বাড়ি নেই, খাবার নেই , কোথায় কখন যাবেন তা নিয়েও সংশয় রয়েছে, তারা ক্ষোভ দেখান শাসক দলের নেতাদের সামনেই ।
জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই এই এলাকা ধস কবলিত। কোম্পানি আমলে এখানে কয়লাখনি ছিল। তখন অবৈজ্ঞানিকভাবে কয়লা খনন করা হয়েছিলো বলে দাবি। পরবর্তীকালে এই এলাকায় অবৈধ খনি হয়েছিল। গোটা এলাকায় সরকারি খাস জমি রয়েছে। সমস্ত অবৈধ খনি ভরাটের পর এলাকাটি দখল নেয় স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে জনবসতি তৈরি হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ডিজিএমএস বা ডিরেক্টর জেনারেল অফ মাইন সেফটি ১৯৯৮ সালে বরাকরকে ধসকবলিত ও বিপজ্জনক এলাকা বলে ঘোষণা করেছে । পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় বরাকরবাসী এখনও এলাকা ছাড়েননি। এখন দেখার বিধান সভা নির্বাচনের আগে শাসক দল ও জেলা প্রশাসন কি করে।