আসানসোল শিল্পাঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টি,তিনজনের মৃত্যু, ২নং জাতীয় সড়ক থেকে হাসপাতাল জলের তলায়
বহু মানুষ আটকে, উদ্ধারে সেনবাহিনীর সঙ্গে এনডিআরএফ ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, নামলো স্পিড বোট
বেঙ্গল মিরর, রাজা বন্দোপাধ্যায়, আসানসোল, ৩০ সেপ্টেম্বরঃ নিম্নচাপের জেরে লাগাতার বৃষ্টিতে একদিনে বা ২৪ ঘন্টায় সর্বকালীন রেকর্ড বৃষ্টি হলো পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল শিল্পাঞ্চলে। বৃহস্পতিবার দুপুরে আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে আসানসোলে ৪৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই পরিমান বৃষ্টি আসানসোল শহর তথা শিল্পাঞ্চলে এর আগে কোনদিনও হয়নি বলে আবহাওয়া অফিস জানায়। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে আসানসোল শহর ও তার আশপাশের এলাকায়।
শুধুমাত্র আসানসোলে বুধবার রাতে ৩৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে শিল্পাঞ্চলের জামুড়িয়া, বার্ণপুর, রানিগঞ্জ, কুলটি, বরাকর, সালানপর , বারাবনি ও চিত্তরঞ্জনের বৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পুলিশ সূত্রে খবর এই বৃষ্টিতে তিনটি পৃথক ঘটনায় এক বৃদ্ধা সহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে আসানসোল উত্তর থানার রেলপারের বাবুয়া তলাওয়ে বাড়িতে জল ঢুকে ঘুমের মধ্যে এক যুবকের মৃত্যু হয়।
মৃত যুবকের নাম নাসিম আনসারি (২৫)। অন্যদিকে, আসানসোলের হিরাপুর থানার বার্ণপুরের রিভারসাইড টাউনশিপ কলোনি ও বারাবনি থানার জামগ্রামের কাশিডাঙ্গায় দেওয়াল চাপা দুজনের মৃত্যু হয়। মৃতরা হলো অনিল কেওড়া (৫০) ও সুকুরমনি বেসরা (৬৫)। আসানসোলের ঘটনাটি ঘটে বুধবার গভীর রাতে এবং বারাবনি ও বার্ণপুরের ঘটনা দুটি ঘটে বৃহস্পতিবার সকালে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে বাড়ির দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে তার তলায় চাপা পড়ে বার্ণপুর ও বারাবনিতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
পশ্চিম বর্ধমান জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালেই জলবন্দি এলাকায় পৌঁছে যায় ডিজাস্টার ম্যামেজমেন্টের উদ্ধারকারী দলকে। পরে পানাগড় সেনা ছাউনি থেকে সেনাবাহিনী ও এনডিআরএফের দলকে উদ্ধারে নামানো হয়। সেনাবাহিনী আসানসোলের কালিপাহাড়ি ও কাল্লায় উদ্ধার কাজ করে। আসানসোলের কালিপাহাড়ি, কল্যানপুর ও রেলপারে বেশকিছু বাড়িতে অনেক মানুষ আটকে পড়েন। তাদেরকে পরে জেলা প্রশাসনের দল এলাকার বাসিন্দাদের সহযোগিতায় উদ্ধার করে।
বৃষ্টিতে ২নং জাতীয় সড়ক জিটি রোড থেকে হাসপাতাল সব কিছুই জলের তলায় চলে যায়।
জানা গেছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে আসানসোল উত্তর থানা এলাকায়। সেখানকার সমগ্র রেলপার জলের তলায় চলে যায়। রেলপারের বাবুয়া তলাও এবং রামকৃষ্ণ ডাঙ্গাল সহ আশপাশের এলাকায় একতলা সমান জল জমে যায়। এই বাবুয়া তলাওয়ে বুধবার রাতে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ঘরে শুয়েছিলো নাসিম আনসারি। রাত বারোটার পরে বাড়িতে জল ঢুকতে শুরু করে। সবার ঘুম ভেঙে যায়। তখন সবাই বাইরে বেরোনোর সময় ঘুমিয়ে থাকা নাসিমকে ঘরের বাইরে আসতে বলে। কিন্তু সে আসেনি।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে এগারোটার সময় নাসিমের খোঁজ শুরু হয়। তখন বাড়ির লোকেরা দেখেন ঘরের মধ্যে জলে ভাসছে নাসিম। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে আসানসোল জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। এদিন দুপুরে আসানসোলের রেলপার এলাকার পরিদর্শনে আসেন পশ্চিম বর্ধমানের জেলাশাসক এস অরুণ প্রসার ও আসানসোল দূর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার এন সুধীর কুমার নীলকান্তম।
আসানসোলের রেলপারের পাশাপাশি আসানসোল শহরের জিটি রোডের চেলিডাঙ্গা, আরডাঙ্গা, দিলদারনগর, এনএস রোড ও হটন রোডের একাংশ জলের তলায় চলে যায়। আসানসোলে পূর্ব রেলের আসানসোল ডিভিশনাল হাসপাতালে জল ঢুকে যায়। জিটি রোডের আসানসোল বাজারে শতাধিক দোকানের মধ্যে জল ঢুকে যায়। বিশেষ করে বস্তিন বাজারের বলতে গেলে সব দোকানেই জল ঢুকে যায়। জলে অনেক দোকানে থাকা জামাকাপড়ের পাশাপাশি অন্য জিনিস নষ্ট হয়ে যায়। সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় কোটি টাকা বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন। দূর্গাপুজোর আগে এমন ক্ষতিতে মাথায় হাত।
জল জমে জামুড়িয়ায় ২ নং জাতীয় সড়কের উপরে ৷ বহু গাড়ির ইঞ্জিনে জল ঢুকে সেগুলি বিকল হয়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ে ৷ যার জেরে ব্যাপক যানজট তৈরি হয় ২ নম্বর জাতীয় সড়কে ৷ এই বৃষ্টিতে জামুড়িয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে ৷ যার জেরে জনজীবনও ব্যাহত হয়ে পড়েছে ৷ বহু মানুষকে উদ্ধার করে স্থানীয় স্কুল ও অন্য জায়গায় আশ্রয় দেওয়া হয়।
জামুড়িয়ার পাশাপাশি রানিগঞ্জে বৃষ্টিতে ডামালিয়া জল প্রকল্পের পাইপলাইনের বিরাট একটা অংশ ভেসে যায়। এলাকার একটি ব্রিজ বৃষ্টিতে জলের তোড়ে ভেঙে যায়। খবর পেয়ে এলাকায় আসেন বিধায়ক তথা আসানসোল দূর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ বা আড্ডার চেয়ারম্যান তাপস বন্দোপাধ্যায়। তিনি বলেন, পাইপলাইন ভেসে যাওয়ায় আগামী ৪৮ ঘন্টা জল সরবরাহ ব্যহত হবে।
এই পরিস্থিতিতে দুর্গতদের সহযোগিতা করার জন্য আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর সকলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই নম্বরে ফোন করে অনেকেই সহযোগিতা চেয়েছেন।
এদিকে সালানপুর ব্লকে বড় কোন বিপর্যয় না ঘটলেও বেশকিছু বাড়ি ভেঙে পড়েছে বলে জানা গেছে। বিডিও অদিতি বসু বলেন, বাড়ি ভেঙে পড়ার সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বেড়ে চলেছে। এই বৃষ্টিতে এই ব্লকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা অরবিন্দনগর ও কল্যাণগ্রামে। সেখানে বহু বাড়ির পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। অনেক বাড়ির একতলায় জল ঢুকে পড়ে । অন্যদিকে চিত্তরঞ্জন রেল শহরের ফতেপুর ও সিমজুড়ির মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী প্রধান রাস্তাটি এক মানুষ সমান জলের তলায় ডুবে যায়।
জেলাশাসক জানিয়েছেন, পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হয়েছে। উদ্ধারকার্য চলছে। বেশকিছু মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।