” গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু”.. ইন্দ্রধনুর দেশে পাড়ি দিলেন “গীতশ্রী” সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
বেঙ্গল মিরর, সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত : আবার থেমে গেল বাংলা তথা দেশের আরেক সুর সম্রাজ্ঞীর কণ্ঠ।
চলে গেলেন বাংলার প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী।




থেমে গেল বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। তাঁর কন্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে রয়েছে কয়েক প্রজন্ম। ৫০ বছরেরও বেশি সময় নানা ভাষার ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন তিনি। ছবির গানের পাশাপাশি বাংলা আধুনিক গান ও ধ্রুপদী সঙ্গীতেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁর শিষ্যা ছিলেন তিনি। ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার মূল কান্ডারী ছিলেন তাঁর দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি। কলম্বিয়া থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড করা গান গিরীন চক্রবর্তীর কথায় ও সুরে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ ও ‘তোমার আকাশে ঝিলমিল করে’। ১৯৪৮ সালে প্রথমবার রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত পরিচালনায় প্লেব্যাক করেন, ছবির নাম ‘অঞ্জনগড়’। ওই একই বছরে আরও তিনটি আধুনিক গান রেকর্ড করে সঙ্গীতজগতে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন ভবিষ্যতের কিংবদন্তি।
বাংলা বেসিক আধুনিক গানের সম্রাজ্ঞী ১৯৫০ সালে মুম্বই পাড়ি দেন । ১৭ টি হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক করেন তিনি। শুরু হয়েছিল তাঁর বম্বে সফরশচীন দেব বর্মনের হাত ধরে শচীন দেববর্মন নিয়ে গেলেও মুম্বইয়ে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ হল অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তারানা’ ছবিতে। সন্ধ্যার বড়দাই মুম্বইয়ে অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই ছবিতে গান গাইতে গিয়েই তাঁর পরিচয় হয় লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। লতার সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন ‘ বোল পাপিহে বোল রে’, ‘তু বোল পাপিহে বোল’। গানের সূত্রে দুজনে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে সন্ধ্যার ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও এসেছেন লতা মঙ্গেশকর। রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেব বর্মন থেকে শুরু করে সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ সেই সময়ের সমস্ত দিকপাল সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। উত্তম সুচিত্রার লিপে তাঁর ও হেমন্তের রোমান্টিক গান আজও সমান জনপ্রিয়। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’,’এ শুধু গানের দিন’,’এই মধুরাত’ গানগুলো আজও বাঙালির কাছে রোমান্টিসিজমের সমার্থক।
ছবির গানের পাশাপাশি সমান জনপ্রিয় তার গাওয়া বাংলা কিছু গান। ‘হয়ত কিছুই নাহি পাবো’,’আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে’,’মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’,’শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি’,’চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে’-র মতো অসংখ্য কালজয়ী গান তাঁকে অমর করে রেখেছে সঙ্গীতের দুনিয়ায়। ১৯৭১ সালে ‘জয়জয়ন্তী’ ও ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গান গেয়ে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৯সালে লাইফটাইম অ্য়াচিভমেন্টের জন্য ভারত নির্মান পুরস্কার পান। ২০১১ সালে বঙ্গবিভূষণ সম্মান পান তিনি। ২০২২ সালে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু এতদিন সে সম্মান তাঁকে না দেওয়ায় অভিমানে পদ্মশ্রী প্রত্যাখান করেন তিনি।
জীবনে একের পর এক মাইলস্টোন অতিক্রম করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বরাবরই স্নিগ্ধ, নম্র ব্যবহারের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত সারা বিশ্বের বিশেষত বাংলা গানের ভক্তরা সহ শিল্পীমহল।