আসানসোলকে বিপজ্জনক করে তুলেছে কয়লা খনির ভেতরে জ্বলতে থাকা ভয়ংকর আগুন
আসানসোল অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা আর কয়েক বছরের মধ্যেই ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে
বেঙ্গল মিরর, আসানসোল: গত ৩০ বছরে আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 9 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু জুন মাসের বৃষ্টি পিছোতে পিছোতে গিয়ে পৌঁচেছে অক্টোবরে। আবার গত ১০ বছরে বিশেষ করে আসানসোল ও সন্নিহিত এলাকার রাতের তাপমাত্রা সারা বছরই প্রায় একই রকম ঊর্ধ্বমুখী থাকছে, যা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। খামখেয়ালী এই আবহাওয়া গড়ে উঠছে মারাত্মক দূষণের জন্য। এই দূষণকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আসানসোল অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা আর কয়েক বছরের মধ্যেই ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে, যেখানে মানুষের বেঁচে থাকাটাই দুর্দায় হয়ে দাঁড়াবে। এইরকমই নানান বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আসানসোল খুব দ্রুত যোশীমঠ হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। এর কারণ মাত্রাহীন ধস।
এমনই নানান প্রসঙ্গ একেবারে নতুন করে উত্থাপিত হলো আসানসোলে ২৫ জুলাই পরিবেশ সাংবাদিকতা নিয়ে অত্যন্ত বলিষ্ঠ এক কর্মশালায়। পরিবেশ সাংবাদিকতা বিষয়টিকে সারা পৃথিবীতেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তার কারণ শুধুমাত্র পরিবেশকে ধ্বংস করে দেওয়ার কারণেই এই পৃথিবী আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। সেই সংকট সমগ্র পৃথিবীর মতোই একেবারে আমাদের ঘরের দরজা আসানসোল দুর্গাপুর অঞ্চলেও উপস্থিত। এই বিষয়টিকেই বুঝে নেওয়া এবং তার থেকে উত্তরণ ঘটাতে সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে এই কর্মশালা দিনভর চর্চা করেছে। এই আলোচনায় অংশ নেন আইআইটি কানপুরের জাস্ট ট্রান্সমিশন রিসার্চ সেন্টার (জেটিআরসি)- এর অধ্যাপক প্রফেসর প্রদীপ স্বর্ণকার, কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশীষ সুর, আন্তর্জাতিক স্তরের পরিবেশ সাংবাদিক তথা এনজিও সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা জয়ন্ত বসু, সাংবাদিকতা পাঠক্রমের অন্যতম শিক্ষক মিডিয়া এডভাইজার (এস এন ইউ) বুড়োশিব দাশগুপ্ত এবং খ্যাতিমান পরিবেশ সাংবাদিক জয়জিত দাস।
এই আলোচনাকে আরো সমৃদ্ধ করেন ৫০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করা বিশিষ্ট সাংবাদিক বিশ্বদেব ভট্টাচার্য ,ডঃ প্রদীপ সুমন, এবং কাঞ্চন সিদ্দিকী। বিশ্বদেব ভট্টাচার্য পরিসংখ্যান তুলে বলেন, আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল সমস্ত দিক দিয়েই চরম দূষিত হয়ে উঠেছে। যে তিন নদী – অজয়, দামোদর, জামুরিয়ার সিঙ্গারিনি এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে একসময় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়েছিল তাই এখন দূষণের ফলে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এমনকি এই সব নদীগুলি ক্রমশ দখল হচ্ছে। একের পর এক গাছ কাটার ঘটনা ঘটছে কয়লা বা বালি বোঝাই ট্রাকে কখনোই তা ঢাকা দিনে যাওয়া হচ্ছে না ইটভাটা সরকারি খাতায় রেজিস্টার্ড ছাড়াই শয়ে শোয়ে চলছে শিল্পাঞ্চলে। একাধিক কারখানা ভয়ংকর দূষণ ছড়াচ্ছে জামুরিয়া মঙ্গলপুর এবং কল্যাণেশ্বরী শিল্প এলাকায় গেলে তার ছবি মেলে। রাজ্য এবং কেন্দ্রে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই পালন করেন না স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের দূষণে এখন আসানসোল দুর্গাপুর সেরা হয়ে উঠছে এর বিরুদ্ধেই সাংবাদিকদের আরো কলম কে শক্তিশালী করতে হবে।
অন্যদিকে কয়লা এবং ইস্পাত ও বিদ্যুৎ এই অঞ্চলকে পশ্চিম জার্মানির রূঢ় অঞ্চলের সঙ্গে এক আসনে বসিয়েছিল। অথচ সারা পৃথিবী আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাটির নিচে থেকে কয়লা তোলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে পৃথিবীরই বেঁচে থাকার স্বার্থে। যদিও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ২০৩০ থেকে ২০৫০-এর মধ্যে এই কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও ভারত 20৭০ সাল পর্যন্ত সময় নিয়েছে । ফলে আসানসোল শিল্পাঞ্চল তার অস্তিত্ব কিভাবে টিকিয়ে রাখবে সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বনাঞ্চলের শতাংশ মাত্রই ৪। এরফলে দৈনন্দিন তাপমাত্রা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যেই এখানকার মানুষকে চলমান এসি গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরোতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এমন অবস্থায় সাংবাদিকরা শুধু রাজনৈতিক তরজা, খেলার মাঠের উত্তেজনা আর উদ্বোধনের ফিতে কাটার সংবাদ করে এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না। পরিবেশকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে।
এই কাজে আইআইটি কানপুর সম্পূর্ণ একটি পৃথক বিভাগ চালু করেছে। এগিয়ে এসেছে এনজিওর মত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। তাদের হাত ধরে আসানসোলে আইআইটি কানপুরের এই বিভাগ একটি বর্ধিত ক্যাম্পাস শুরু করারও চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেল। কিন্তু আসানসোল দুর্গাপুর ও সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে দূষণমুক্ত করার জন্য বছর বছর যে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ সরকারি স্তরে মঞ্জুর হয় তার প্রায় কিছুই দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হয় না। পরিসংখ্যান বলছে আসানসোল অঞ্চলের জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সাম্প্রতিক সময়ে আসানসোলের জন্য ৬৭ কোটি টাকা এবং দুর্গাপুরের জন্য ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও তাতে হাত পড়েনি স্থানীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থার। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ নব দত্ত এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি কল্যাণ রুদ্র।
অন্যদিকে কারখানার ধোঁয়া, আগুনের মতই আসানসোলকে বিপজ্জনক করে তুলেছে কয়লা খনির ভেতরে জ্বলতে থাকা ভয়ংকর আগুন। গত আড়াই বছরে এখানকার খনি গুলিতে অন্ততপক্ষে আড়াই হাজার আগুন লাগার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এই অবস্থায় পৃথিবীকে বাঁচাতে কলম ধরতে হবে বলিষ্ঠ সাংবাদিকদের। তারা পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলনকারীদের সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। সাংবাদিকদের লেখার জেরেই বিপর্যস্ত সুন্দরবন আজ সারা পৃথিবীর গোচরে এসেছে। আসানসোলও নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সারা পৃথিবীর নজর কাড়ুক – সেই আশা ব্যক্ত করা হয় এদিনের কথাবার্তায়। আসানসোল দুর্গাপুর অঞ্চলের নির্বাচিত সাংবাদিকেরা এদিন পারস্পরিক আলোচনায় এই অঞ্চলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসার অঙ্গীকার করেন। পৃথিবী এখন যে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পৌঁচেছে তার থেকে যেন আরও খারাপ স্তরে চলে না যায় তা নিশ্চিত করাই পরিবেশ সাংবাদিকদের লক্ষ্য হবে বলে এদিন স্থির হয়।
আলোচনায় সকলেই বলেন রাজনৈতিক ঝগড়া করে এই পৃথিবীকে আর বাঁচানো যাবে না, তার জন্য প্রয়োজন যে সব আন্তর্জাতিক চুক্তি পৃথিবীর দুশোরও বেশি দেশ করেছে তাকে একেবারে প্রতিটি স্তরে মেনে চলা। তা হচ্ছে কিনা দেখতে হবে পরিবেশ সাংবাদিকদের। সমস্ত দেশকে ক্ষতিকর পন্থাগুলি থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে পরিবেশের উপযোগী পন্থায় মসৃণভাবে পৌঁছতে হবে বলে এদিন উল্লেখ করা হয়। সম্পূর্ণ নতুন এক সাংবাদিকতার পথ এদিন শিল্পাঞ্চলের সাংবাদিকদের সামনে খুলে গেল বলে সকলেই মত প্রকাশ করেন। যদিও সারা পৃথিবীতে পরিবেশ সাংবাদিকেরাই সঙ্গবদ্ধভাবে মাফিয়াদের আক্রোশের শিকার হচ্ছেন, তবুও এই পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখা এবং আরও কোটি কোটি বছর টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সাংবাদিকদের পালন করে যেতে হবে বলে এদিন সকলেই উল্লেখ করেন।