শ্রীবালানন্দ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে রিষড়া প্রেম মন্দির আশ্রমের সংযোগ : কল্যাণ চক্রবর্তী
১১ ই মার্চ সন্ধ্যায় রিষড়া প্রেম মন্দির আশ্রমে অনন্তশ্রী বালানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজের আবির্ভাব তিথি (গোবিন্দ দ্বাদশী) উপলক্ষে একটি ধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রেক্ষিতেই এই আলোচনা।
নর্মদা মায়ের সন্তান অনন্তশ্রী ব্রহ্মানন্দজীর সুযোগ্য শিষ্য, শ্রীরামকৃষ্ণ সমকালীন যোগী-মহাপুরুষ শ্রী বালানন্দ ব্রহ্মচারীজীকে (১৮২৯/১৮৩০/১৮৩২-১৯৩৭) ‘সচল বৈদ্যনাথ’ নামে ভারতের আধ্যাত্মিক জগত চেনেন। বালানন্দজীর সুযোগ্য শিষ্য ও পার্ষদ ছিলেন শ্রীতারানন্দ ব্রহ্মচারী (১৯০১-১৯৮১), যাঁর পরশে গড়ে উঠেছে রিষড়া প্রেম মন্দির আশ্রম।




আনুমানিক ১৮২৯ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে বালানন্দজীর জন্ম উজ্জয়িনীর এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পূজারী-পরিবারে। আর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্ম ১৮৩৬ সালে। বালানন্দজী অতি অল্প বয়সেই গৃহত্যাগী হন। বাল্যকালেই তিনি নর্মদা নদীর চারপাশে এক দীর্ঘপথ পদব্রজে পরিক্রমা করতে সংকল্পবদ্ধ হলেন। কখনও গহীন বন, কখনও জনপদ-লোকালয়, কখনও কৃষিভূমি, কখনও পাহাড়ি অঞ্চল, কখনও উপনদীর সঙ্গমস্থল পেরিয়ে এলেন। সঙ্গে কুলুকুলু ছন্দে আপন সৌন্দর্যে বয়ে চলেছে নদী। নর্মদার পথে পথে পরিক্রমা করতে করতে বালানন্দজী ভারতীয় সংস্কৃতি ও বহু পুণ্যশ্লোক সাধুসন্তের অতুল্য পরশ পেলেন। তীরে তীরে মন্দির-দেবালয়ের বিগ্রহ দর্শন হল। লাভ করলেন পরমারাধ্য গুরুদেবকে, বরণ করে নিলেন চির-সন্ন্যাস। মানব জাতির মঙ্গলের জন্য তাঁর ঐশী সাধনা শুরু হল তুরীয়ানন্দে।
বাল-ব্রহ্মচারীর সিদ্ধ যোগী হয়ে ওঠার অপরূপ আনন্দ-কথনের মধ্যে সনাতনী ভারতবর্ষের চিরকালীন অমৃতময় জীবনের চলচ্চিত্র। নর্মদার বরপুত্র পরম শ্রদ্ধেয় গৌরীশঙ্কর মহারাজের কাছে বালানন্দজীর যোগ শিক্ষার কথায়, উত্তরাখণ্ড সহ পূর্ব ভারত ও হিমালয়ের পথে পথে পদব্রজের পর্যটনে রয়েছে এক স্বর্গীয় রোমাঞ্চ। তপস্যা, সিদ্ধি, হরিদ্বারে শিষ্যের সঙ্গে সম্মিলন, কাশীধামে আগমন, বৈদ্যনাথ ধামে অবস্থানের পুণ্যকথার পরতে পরতে রয়েছে এক বিপুল আধ্যাত্মিক সম্পদ।
বালানন্দজীর দিব্য পারম্পর্যে এসেছিলেন শ্রীতারানন্দ, শ্রীসত্যানন্দ, শ্রীপরমানন্দ, শ্রীমোহনানন্দ, শ্রীকৃষ্ণানন্দ প্রমুখ বাঙালি শাস্ত্রানুরাগী মহারাজেরা। শ্রীতারানন্দজী রিষড়ার প্রেম মন্দির আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর স্নেহধন্য, বর্তমান আশ্রমাধ্যক্ষ শ্রীমৎ দেবানন্দজী মহারাজ। নদীর ধারার মতোই আধ্যাত্মিক পথের এক চলমান ধারা, এক নাব্য পারম্পর্য। নর্মদা আর গঙ্গা কীভাবে যেন মিলেমিশে গেল! নর্মদা-সন্ন্যাসীর প্রেম গঙ্গা-সন্ন্যাসীতে মিশলো। গঙ্গাতীরে গড়ে উঠলো প্রেম মন্দিরের আশ্রম প্রাঙ্গন৷
১৩৪০ বঙ্গাব্দের মাঘ মণ্ডলে গঙ্গার তীরে এক ছোট্ট সাধন কুটির তৈরী হয়েছিল। কালের বিবর্তনে তা প্রেমরূপ বিগ্রহ ধরে প্রাণস্পর্শী হয়েছে। এই প্রেম হল বহুদর্শী, বহুর মধ্যে একত্ব অনুসন্ধান। ব্রহ্মলীন অনুভূতি; তারায় তারায় খচিত তারানন্দ।
‘প্রেম’ শিরোনামে তারানন্দজীর একটি কবিতা আছে।
“প্রেম! তুমি আরাধ্য আমার,
তোমারে করিয়া সার হব আমি ভব পার।”
“প্রেম! তুমি অমৃত অক্ষয়
মরণ তোমার কাছে পায় পরাজয়।
সে শুধু করাল গ্রাসে, নশ্বর এ দেহ নাশে,
অন্তরে জাগিয়া রহে মূরতি চিণ্ময়,
প্রেম! তুমি অমৃত অক্ষয়।।” প্রেম মহাশক্তিধর, প্রেম চিরানন্দময়, লোকময় অমূল্যরতন, অবিনাশী, অমর, স্পর্শমণি। ঈশ্বর চিরকালের দাতা। আমাদের জীব-শরীর চিরকালের গ্রহীতা। ঈশ্বরও গ্রহণ করতে চান। হাত পেতে চাইছেন তিনি আমাদের কাছে। রাজার রাজা চাইছেন। মনুষ্য নামক জীবের হৃদয়ে যে প্রেমের অনুভূতি আছে ভগবানকে তা পেতেই হবে। এটুকু দিতে পারবো না আমরা? পারবো না আমরা দিতে?
“আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥”