করোনা আবহে ৬২৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম দেবলয়ের চৌকাঠ পেরোতে পারলেন না হুগলির মাহেশের জগন্নাথদেব; প্রতিভু মাসির বাড়ি পৌঁছল
মাহেশ( হুগলি), বেঙ্গল মিরর, সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত:
করোনা আবহে সারা দেশে কিছু বিষয়ে ছাড় সমেত লক ডাউন জারী রয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও আদালতের নির্দেশ থাকার কারণে শর্তসাপেক্ষে পুরীর জগন্নাথ দেব রথে চড়ে তাঁর মাসির বাড়ি গেলেন। তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিচারে এশিয়ায় মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম মাহেশের রথযাত্রা ৬২৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এবার স্থগিত রাখলেন জগন্নাথ ট্রাস্টি বোর্ড। আর রথে ওঠা হয়ে উঠলো না হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মাহেশের জগন্নাথ মহাপ্রভুর।
এই কারণবশত: নিয়মমাত্র জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা এবার সারা হয়েছিল । সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি অন্যান্য প্রশাসনিক নির্দেশিকা মেনে মাত্র ২৫ জন ভক্তের উপস্থিতিতেই এদিন সকাল থেকে রীতিনীতি ও নিয়ম মেনেই জগন্নাথ দেবের পুজো শুরু হয়। যথারীতি ভোগ উপাচার পর্ব শেষে জগন্নাথ দেব যেহেতু এবার তাঁর দেবালয়ের চৌকাঠ পেরোবেন না তাই রথ এর তিনটি পাক সম্পন্ন করে হরিসংকীর্তন সহযোগে সেবাইতরা তিন দেবতার তিন প্রতিভু হিসবে তিনটি নারায়ণ শীলা নিয়ে রওনা দেন জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি গর্ভগৃহ থেকে বের করে আপাতত রাখা থাকছে পাশের মন্দিরে। করোনা যে কতটা ভয়ংকর হতে পরে তা বলতে গেলে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন জগন্নাথের ভক্তরা।
অতিরিক্ত ভক্ত যাতে মন্দিরে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য মন্দিরের প্রধান ফটকে যেমন দিনভর চলে পুলিশের নজরদারি। সেইসঙ্গে নারায়ন শীলার রথযাত্রায় যাতে অতিরিক্ত জনসমাগম না হয় এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হয় তার জন্যও মানুষকে সচেতন করতে প্রশাসনের থেকে প্রচার চলে সমান তালে।
মাহেশের এই জগন্নাথ দেবের প্রতিষ্ঠা ও তাঁর এই রথযাত্রার একটি ঐতিহাসিক কাহিনি রয়েছে। সালটা ১৫১০। জনৈক সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী জগন্নাথ দর্শনে এসেছেন পুরীধামে। জগন্নাথ দেবকে স্বহস্তে ভোগ নিবেদন করার বাসনা তাঁর। কিন্তু পুরীর পাণ্ডারা ভোগ দিতে দিলেন না। দুঃখে, অপমানে, অনশনে প্রাণত্যাগ করাই স্থির করলেন সাধক ধ্রুবানন্দ। তিনদিনের দিন ইষ্টদেবের স্বপ্নাদেশ পেলেন তিনি। “ধ্রুবানন্দ তুই মাহেশে ফিরে যা। ভাগীরথীতে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে জগন্নাথ, বলরাম,সুভদ্রা-র মূর্তি তৈরী করে সাধনভজন কর। আমি তোর হাত থেকে ভোগ গ্রহণ করার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করবো।” সেই স্বপ্নাদেষ পাওয়ার পরই মাহেশে ফিরে আসেন ধ্রুবানন্দ। এক বর্ষণমুখর রাতে বিদ্যুতের ঝলকানিতে গঙ্গায় ভেসে এল প্রকান্ড নিমকাঠ। সেই নিম কাঠ দিয়েই এক সূত্রধর গড়ে দিলেন মূর্তি। সাধক ধ্রুবানন্দ গঙ্গার ধারেই ছোটো করে তৈরি করেন জগন্নাথ দেবের মন্দির। শুরু হল ধ্রুবানন্দের সাধনা। চৈতন্যদেব যখন মাহেশে আসেন ধ্রুবানন্দ তখন অন্তিম শয্যায়। তাঁর কাতর অনুরোধে চৈতন্যদেব দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম গোপাল ঠাকুর কমলাকর পিপলাইকে ওই মন্দিরের সেবাপুজোর সমস্ত ভার অর্পণ করেন।
কালের গতিতে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড় ভাঙ্গতে থাকায় মন্দিরের গর্ভগৃহটি নদীতে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা যায়। সেইসময় কলকাতার এক বিত্তবান ব্যবসায়ী নয়নচাঁদ মল্লিক গঙ্গার পাড় থেকে মন্দিরটি সরিয়ে নিয়ে আসেন মাহেশের রাজপথ অর্থাৎ জিটি রোডের ওপরে। এখন মাহেশে যে মন্দির ঘিরে রথযাত্রা, পুজো, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে তা সেই নয়নচাঁদেরই তৈরী। মন্দির সামনে একটি নাটমন্দিরও তৈরী করে দেন তিনি। সে সময় মন্দির তৈরী করতে খরচ করেছিলেন ২০,০০০ টাকা। কমলাকরের হাত ধরেই মাহেশের রথযাত্রার সূচনা। মাহেশের বর্তমান প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারী জানান, “পুরীর পর এটিই ভারতের দ্বিতীয় ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম রথযাত্রা”। রথের দিন দু-তিন লক্ষ ভক্তের টানে মহাপ্রভুর রথ সচল হয়। জিটি রোড ধরে দেড় কিমি পথ পেরিয়ে মহাপ্রভু যান শ্রীরামপুরের গুচিন্ডা বাড়ি। ভক্তরা পুজো দেয়, প্রসাদ পায়। রথ থেকে ভক্তদের জন্য ছোঁড়া হয় প্রসাদী কলা, বাতাসা, নকুলদানা। দূর দূরান্ত থেকে দলে দলে লোক আসে মাহেশের রথযাত্রা দর্শন করতে। সঙ্গে থাকে একমাস ব্যাপী মেলা আর মেলার নানা আকর্ষণ। পুরীর পর রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে এমন অনুষ্ঠান ও সমারোহ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। কথিত আছে এই মেলাতেই বঙ্কিমচন্দ্র খুঁজে পান রাধারানীকে। দুঃখিনী একাদশ বর্ষীয়া সেই বালিকা ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করতে এসেছিল এই রথের মেলায়। এক পয়সার মালা বিক্রি করে অসুস্থ মায়ের পথ্য যোগার করার কথা ভেবেছিলেন রাধারানী। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ শুরু হয় প্রবল ঝড়বৃষ্টি। ফলে মেলা ভেঙে যায়। পথ হারিয়ে কাঁদতে থাকে সে, সেই সময় স্থানীয় এক জমিদার রাধারানীর সমস্ত মালা কিনে নেন। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। রাধারানীর মধ্য দিয়েই মাহেশ বাংলায় নতুন ভাবে গুরুত্ব পায়। আজও মাহেশের মেলায় অনুভব করা যায় কিশোরী মেয়েটির দীর্ঘশ্বাস।
বছর বছর ধরে মাহেশের মেলার জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
এসেছেন বহু ঋষি-মনিষী। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব রথের সময় বেশ কয়েকবার এই মাহেশে এসেছিলেন। এমন বহু মহাপ্রাণের পদধূলিতে ধন্য মাহেশ আজ ভারতের অন্যতম তীর্থভূমি।
পুরীকে বলা হয় ‘নীলাচল’, আর মাহেশের অপর নাম ‘নব নীলাচল’। নীলা চলে এক হাজার শালগ্রাম শিলা দিয়ে তৈরী রত্নবেদীতে প্রতিষ্ঠিত তিন দেবতা জগনাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা দৃশ্যত দন্ডায়মান। কিন্তু নব নীলাচল অর্থাৎ মাহেশে মহাপ্রভু, বলভদ্র ও সুভদ্রা বেদিতে উপবিষ্ট। প্রতি বারো বছর অন্তর পুরীতে নিমকাঠ দিয়ে নতুন মূর্তি তৈরি করে অভিষেক হয় জগনাথ দেবের। কিন্তু মাহেশে ৬২৪ বছর আগের সেই একই মূর্তিতে পুজিত হয়ে চলেছে। মাহেশে প্রথম দিকে যে রথ ব্যবহার হত, তা নষ্ট হলে ১৭৯৩ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদ বলরাম বসুর পিতামহ কৃষ্ণরাম বসু সুদৃশ্য কাঠের রথ তৈরী করে দেন। কালক্রমে এটিও জীর্ণ হলে এই পরিবার ই আবার তার পুনঃনির্মাণ করে দেন। সেই রথটি কয়েকবছর পর দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়। ১৮৫২ সালে পুনরায় নতুন রথ নির্মাণ করেন কালাচাঁদ বসু। একদিন এক ব্যক্তি সেই রথে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে রথটি পরিত্যক্ত হয়। ১৮৫৬ সালে আবার তৈরি হয় নতুন রথ, এটিও কয়েক বছরের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়। তাই এবার আর কাঠের নয়, লোহার রথ তৈরি হয়। ১৮৮৫ সালে হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু মার্টিন বার্ণ কোম্পানী থেকে বর্ধমান রথটি তৈরি করেন। এই পরিবার এখনও সেই রথের দেখাশোনা করে চলেছে।
৪৫ফুট উঁচু এই রথই আজ রথযাত্রার সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। রথের ওজন ১২৫ টন। বিশাল বিশাল ১০টি লোহার চাকায় পথ চলা তার। ৯টি চূড়া বিশিষ্ট রথটি নবরত্ন ধারায় নির্মিত। যার সামনের দিকে দুটি তামার ঘোড়া, একটি নীল ও অন্যটি সাদা। সঙ্গে কাঠের তৈরি এক সারথি আর রয়েছে দুটি রাজহাঁস।
৯টি চূড়ার প্রধানটিতেই জগন্নাথদেবের অবস্থান। নবযৌবন শেষে রাজবেশে তিন দেবতা রথে চড়ে নামেন ভক্ত সমুদ্রে। আড়াই-তিন ঘন্টা ধরে তিনি একটু একটু করে পথ চলেন। পৌঁছন মাসির বাড়িতে। আটদিন সেখানে থেকে উল্টোরথে একইভাবে থেকে আবার জগন্নাথদেব নিজ দেবালয় মাহেশে ফিরে আসেন।
বলাই বাহুল্য এই সাংস্কৃতিক ও নিয়ম নীতির ধারা অনুসরণ করে বহু বছর ধরে ভক্তজনের মনের ঐকান্তিক ইচ্ছায় হুগলির মাহেশে ঐতিহাসিক রথযাত্রা হয়ে আসছে এবং কালের নিয়মে সেটি চলতে থাকবে কারণ ভক্তের ভগবান জগন্নাথ মহাপ্রভু।