ASANSOL

আরপিএফের মধ্যে সমস্ত স্তরের কর্মীদের বাংলা ভাষা শেখানোর কাজ শুরু

বেঙ্গল মিরর, দেব ভট্টাচার্য।  আসানসোল ডিভিশনের রেলওয় প্রটেকশন ফোর্স বা আরপিএফের মধ্যে যারা বাংলা ভাষাভাষী নন,বা বাংলা ভাষা বলতে বুঝতে পারেন না এমন আধিকারিক থেকে কনস্টেবল সহ সমস্ত স্তরের কর্মীদের বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় নিয়ে বাংলা ভাষা শেখানোর কাজ শুরু করলেন এই ডিভিশনের সিনিয়র সিকিউরিটি কমিশনার চন্দ্র মোহন মিশ্র হঠাৎ। কেন সিকিউরিটি কমিশনারের  মাথায় এমন ভাবনা এল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে  চন্দ্র মোহন মিশ্র বলেন আমি বেশ কিছু মাস এই ডিভিশনের দায়িত্বে এসেছি। এই ডিভিশন এর মধ্যে তিনটি রাজ্য বিহার, বাংলা এবং ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন রেল স্টেশন পড়ে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বা যাত্রীদের সুরক্ষা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি দেখেছি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাষা একটা সমস্যা হয়ে যায় ।আমাদের ডিভিশনে ৮৩  জন মহিলা আরপিএফ কর্মীসহ বারোশো আরপিএফ কর্মী আছেন।

যাদের মধ্যে প্রায় ৭০০ জনের বেশি বাংলা ভাষা ভাসি নন বা এই ভাষাটা জানেন না ।এই ভাষা না জানার ফলে একজন যাত্রীর সাথে একজন আরপিএফ কর্মীর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।  একজন সাধারণ মানুষ যখন আরপিএফ কর্মীর কাছে বাংলা ভাষায় এসে হয়তো সাহায্য চাইছেন সেটাও ঠিকমত বোঝা যায় না। সর্বোপরি কাজের সুবাদে যে সমাজের সাথে যুক্ত সেই সমাজের সাথে মিশতে গেলে সেই ভাষা টুকু কাজের প্রয়োজনে আয়ত্ত করতে হয়। এতে সেই এলাকায় কাজ করতে অনেক সুবিধা হয়। তার উপর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ও স্থানীয় ভাষা একটা বড় হাতিয়ার বলা যায়। এই সমস্ত দিক থেকেই আমার মনে হয়েছে আমি নিজে সবসময়ই চেষ্টা করেছি কিছুটা বাংলা শিখতে এবং অন্যদের এব্যাপারে উৎসাহিত করতে। আর সেই কারনেই কয়েকজনকে নিয়ে আমি আমাদের আরপিএফ আধিকারিক থেকে কর্মীদের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি টিম তৈরি করেছি। এই টিমের মধ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের ইন্সপেক্টর দীপঙ্কর দে। যিনি নিজে  ভালো হিন্দি  এবং বাংলা জানেন। এছাড়া আছেন আরেকজন ইন্সপেক্টর অলক গড়াই, মহিলা সাব-ইন্সপেক্টর শুভ্রা দে, নন্দিতা, কনস্টেবল  মনোদিপ দাস এবং কনস্টেবল দীনেশ রক্ষিত এবং হিন্দি এবং বাংলা ভাষাটা   জানেন যেমন দীপঙ্কর বাবু আছেন তেমনি আরেকজন সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর আছেন ধর্মেন্দ্র প্রসাদ। 

 সিনিয়র সিকিউরিটি কমিশনার বলেন আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রত্যেককে সংগ্রহ করতে বলেছি। আমাদেরই কেউ কেউ সেটা ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করেও নিয়েছেন এবং সদ্য পড়াশোনার ক্লাস শুরু হয়েছে। আমার ইচ্ছে আগামী দিনে এদের নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স করার পর তারা কতটা কি শিখলেন তারও নিজেদের মধ্যেই একটা ন্যূনতম লেখা এবং পড়ার প্রতিযোগিতা ও থাকবে ।যেখানে তাদের পুরস্কৃত করা হবে ।তবে ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে শিখতে আসা  বেশ কয়েকজন উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আমার নিজের আরেকটি ইচ্ছে আছে আগামী দিনে আমি যদি দেখি সবাই খুব বিষয়টি ভালো করে শিখছেন সে ক্ষেত্রে আমি নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রেমচন্দের অনুবাদ বিভিন্ন গল্প ও কবিতা প্রবন্ধ লেখা বিভিন্ন ধরনের বই এদের হাতে তুলে দিতে চাই।  আমাযদের ডিভিশনে একটা সময় খুব অভিযোগ আসছিল  রেল লাইনের ধারেকোন কোন গ্রাম এলাকা থেকে যাত্রী ট্রেনে পাথর ছোড়া হতো। আমরা সেখানে গিয়ে যাত্রীদের বুঝিয়েছি। এরমধ্যে  যেহেতু পশ্চিমবাংলার বিরাট এলাকার মধ্যে কিছু গ্রাম পড়ে বা বাংলা লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের মধ্যে পড়ে সেখানে বাংলাভাষায় আমাদের যে কর্মীরা গ্রামে গিয়ে বুঝিয়েছেন তাতে তাদের বুঝতে কিন্তু ওদের সুবিধা হয়েছে। গত কয়েক মাসে পাথর ছোড়ার আরেকটি ঘটনা এই ডিভিশনে ঘটেনি। আবার ধরুন ট্রেনে কোনো যাত্রী নেমে কোনো কারণে আরপিএফ তার হয়তো কোন কিছু পরীক্ষা করতে চান। কিন্তু ভাষাগত সংকটে ওই যাত্রীর ইগোতে লাগায় একটা সমস্যা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে যদি আমাদের সহকর্মী বাংলা ভাষা জানেন এবং বুঝিয়ে বলেন যে কেন এটা প্রয়োজন তাহলে কোন সমস্যাই থাকবেনা।

এই প্রকল্পের যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি আরপিএফ এর সমগ্র পূর্ব রেলের অপরাধীদের গোপন কাজকর্ম ধরে ফেলার ক্ষেত্রে  সি আই বিরএকজন বিশেষ ইন্সপেক্টর বলা যায়। তিনি হচ্ছেন দীপঙ্কর দে। দীপঙ্কর বাবু বলেন প্রাথমিকভাবে আমরা তিন সপ্তাহের ১০ জনকে জনকে নিয়ে টানা এই কোর্স পড়াচ্ছি। এরমধ্যে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে বোর্ড এ যেমন অক্ষর জানানো হচ্ছে সহজপাঠ ধরে ধরে   তেমনি শব্দ গঠন কিভাবে হয়, যুক্তাক্ষর কি তাও পড়ানো হচ্ছে । আমরা বোর্ডে চক দিয়ে  বাংলা এবং হিন্দি তে  একই অক্ষর পাশাপাশি লিখছি। যাতে বাংলায় ক আর হিন্দিতে ক কিরকম হয় তা বুঝতে পারেন।  আমরা প্রজেক্টর এর সাহায্যেও পড়াব । হিন্দি থেকে বাংলা খুব ভালো করতে পারেন এমন সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর ধর্মেন্দ্র প্রসাদ এবং কনস্টেবল দীনেশ রক্ষিত তারা যেমন আছেন তেমনই ইন্সপেক্টর অলক গড়াই ,সাব-ইন্সপেক্টর শুভ্রা দে শ কয়েকজন আছে। আমাদের ইচ্ছে আছে এই কোর্স যখন ব্যাচে শেষ হয়ে যাবে তখন আমরা বাংলায় রচনা লেখা বা বাংলা পড়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা মধ্যে দিয়ে সেরাদের কমান্ডেন্ট সাহেবের মাধ্যমে পুরস্কৃত করাব। আমরা মনে করি ভাষা এলাকার সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে বুঝতে সাহায্য করে ।

সোমবার যারা আসানসোলে আরপিএফ এর রিজার্ভ অফিসেই এই ক্লাস করছিলেন তাদের মধ্যে কনস্টেবল পূজা সিংহ, প্রকাশ যাদব, রমেশ পান্ডের খুব খুশি। এরা তিনজনেই আসানসোল ডিভিশনে বাইরে থেকে চাকরি করতে এসেছেন। এরা একেবারেই বাংলা ভাষা জানেন না ।প্রতিদিন একটু একটু করে তারা শিখছেন এবং এটা তাদের চাকরির ক্ষেত্রে শুধু নয় আগামী দিনে ভীষণ কাজে লাগবে বলে তারা মনে করেন। যে পদ্ধতিতে তাদের পড়ানো হচ্ছে এতেও তারা খুব খুশি। বলেন নিজেদের ছোটবেলায় স্কুল-কলেজের জীবনের কথা মনে পড়ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আসানসোল ডিভিশন এর মধ্যেই পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সারা জীবনের অন্যতম শিক্ষা ও কর্মস্থলের একটি বড় জায়গা কারমাটার। যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর রেল স্টেশন নামে পরিচিত। এই বিদ্যাসাগর স্টেশন থেকে বর্তমান ডিভিশনাল ম্যানেজার সুমিত সরকার সেখানে বিদ্যাসাগরের সহজপাঠ এর সমস্ত কিছু ছবির মাধ্যমে দেওয়ালে দেওয়ালে আকিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি ও আছে। একইসঙ্গে পাশেই বিদ্যাসাগর যে সমিতি আছে এবং বিদ্যাসাগর যে জায়গা থেকে কাজ করতেন সেখানে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে ডি আর এম কয়েকদিন আগে গিয়ে মাল্যদান করে এলেন। এই আসানসোল ডিভিশনে বাংলা ঝারখন্ড সীমানার রুপনারায়নপুর রেলস্টেশনে বছর দুয়েক আগে  বাংলা ভাষাতে ট্রেন যাতায়াতের ঘোষণা আচমকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ভাবনা পুরো বিষয়টি পূর্ব রেলের আধিকারিক ও তদানীন্তন ডি আর এমের  কাছে প্রতিবাদ করে চিঠি পাঠায় ।৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রেল কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল স্বীকার করে আবার বাংলা প্রচার শুরু করেছিলেন।

 এই জায়গায় দাঁড়িয়ে দিল্লি থেকে আসা একজন  হিন্দিভাষী মানুষ সিনিয়র সিকিউরিটি কমিশনার চন্দ্রমোহন  মিশ্র আরপিএফ কর্মীদের বাংলা ভাষা শেখানোর যে পরিকল্পনা এবং তাকে কাজের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করার  উদ্যোগ নিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। একই সঙ্গে তিনি ভাষা প্রশিক্ষণের সাথে সাথে মহিলা আরপিএফ কর্মীদের মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ এবং যাত্রী থেকে আর পি এফের অফিসে দেখা করতে আসা আমজনতার সাথে কিভাবে ভালো ব্যবহার করা যায় তাও শেখানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

News Editor

Mr. Chandan | Senior News Editor Profile Mr. Chandan is a highly respected and seasoned Senior News Editor who brings over two decades (20+ years) of distinguished experience in the print media industry to the Bengal Mirror team. His extensive expertise is instrumental in upholding our commitment to quality, accuracy, and the #ThinkPositive journalistic standard.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *