আসানসোলের তিন দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা, পরিবারের আর্থিক বাধা কাটিয়ে মাধ্যমিক পাশ করল
বেঙ্গল মিরর, দেব ভট্টাচার্য ও রাজা বন্দোপাধ্যায়, আসানসোল, ৭ জুনঃ এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় আসানসোলের তিন দৃষ্টিহীন ছেলে ও মেয়ে উল্লেখযোগ্য রেজাল্ট করলো। অভাবী পরিবারের ( জন্মান্ধ) দৃষ্টিহীন এই তিনজন ভাল ফল করায় খুশি। তিনজনই চায়, আগামী দিনের পড়াশোনা নিয়েই এগিয়ে যেতে। তিনজনই শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করতে বা শিক্ষকের মতো পেশা বেছে নিতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী পরিবারের আর্থিক সংকট ।স্বাভাবিকভাবেই তাদের পড়াশোনার জন্য কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে তারা অবশ্যই তা গ্রহণ করবেন।




এই তিনজনের প্রথম জন হল ভাগ্যবতী মুদি। তার বাড়ি পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের সালানপুর ব্লকের এথোড়া এলাকায়। ভাগ্যবতির বাবা হলধর মুদি রাজমিস্ত্রির কাজ করে কোনমতে সংসার চালান। করোনার সময় তার প্রায় কাজ ছিল না বললেই চলে। অর্থের অভাবের মধ্যেও তার দাদা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। কিন্তু তারপর পড়া বন্ধ। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে ৫৪০ নম্বর পেয়ে প্রথম ডিভিসনে পাস করেছে কলকাতা ব্লাইন্ড স্কুল থেকে।
ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ভাগ্যবতি আসানসোলের ব্রেল একাডেমিতে পড়াশোনা করেছিলো। তারপর সে ব্লাইন্ড স্কুলে পড়তে চলে যায়। তার বিষয় ভিত্তিক নম্বরের মধ্যে রয়েছে জীবন বিজ্ঞানে ৯০, ইতিহাসে ৮২ ও ভূগোলে ৯০ পায় সে। আগামী দিনে সে শিক্ষিকা হয়ে ছেলেমেয়েদের বোঝাবো দৃষ্টিহীনতা মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। মনের জোর ও উদ্দোম থাকতে হয়।
একইভাবে আসানসোলের রানিগঞ্জের জেকে নগরের বাসিন্দা সুষমা চৌধুরী এবছরের মাধ্যমিকে ৫১৬ নম্বর পেয়ে প্রথম ডিভিসনে পাস করেছে।সেও আসানসোলের ব্রেইল একাডেমী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে বেহালার ব্লাইন্ড স্কুলে চলে যায়। সেখান থেকে পড়াশোনা করে এবার সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলো। সুষমা জীবন বিজ্ঞানে ৮৬, ইতিহাসে ৮৩, ভূগোলে ৯০, ইংরেজিতে ৭১ নম্বর পেয়েছে। সুষমার বাবা নেই। মা অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান।
তারা চার বোন ও এক ভাই। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সুষমা বলে, আজ বড় মনে পড়ছে জেকে নগরের একজন ম্যাডামের কথা। যিনি উদ্যোগ নিয়ে আমি জন্মান্ধ থাকায় আমাকে আসানসোলের ব্রেইল একাডেমি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তাই আমার চোখ না থাকলেও শিক্ষার আলোয় আমি আলোকিত হচ্ছি। সে চায় একজন অধ্যাপিকা হতে।
অন্যদিকে, আসানসোলের কালিপাহাড়ির বাসিন্দা কিষান গরাই জন্মান্ধ হওয়ায় সুষমা ও ভাগ্যবতির মতো আসানসোল ব্রেইল একাডেমিতে ভর্তি হয়। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে সোজা চলে যায় নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড স্কুলে। তারপর থেকে সেখানেই পড়াশোনা করে এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া। কিষানের বাবা একটি গ্যাস এজেন্সিতে গ্যাস ডেলিভারির মতো সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার পরিবারে আর্থিক অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। তার ইচ্ছে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়ে শিক্ষক হওয়া । সুযোগ পেলে ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে চায়। কেননা ইতিহাস তার অন্যতম প্রিয় বিষয়।
পড়াশোনা করার পাশাপাশি গানও শিখেছে কিষান। তার প্রিয় গল্পকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার একাধিক গল্পের চরিত্র তাকে উৎসাহিত করে। কিষান জানায়, আমি বেলুড় মঠ রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে গান গেয়ে এসেছি। তবে দ্বিতীয় বিভাগে সে পাস করেছে। আরেকটু ভালো ফল আশা করেছিল কিষান। সুযোগ পেলেই সে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হতে চায়। না হলে অন্য কোথাও ভর্তি হয়ে পড়াশোনা পড়বে ।
তবে এই তিনজনেরই জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ায় মুল বাঁধা অর্থ। যদি কোন সংস্থা বা ব্যক্তি সহযোগিতা করার মনোভাব নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে তারা আগামী দিনে নিজেদের দেখা স্বপ্ন সফল করতে পারবে।