ASANSOLRANIGANJ-JAMURIA

সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির স্মরণে শোক মিছিল

বেঙ্গল মিরর, আসানসোল ও রানীগঞ্জ, সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত ও চরণ মুখার্জী : ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্কসবাদী সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়াচুরি দীর্ঘ অসুস্থতার পরে বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লির এইমস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর স্মরণে শুক্রবার সিপিআইএম পার্টির পক্ষ থেকে আসানসোলের গির্জা মোড় থেকে একটি শোক মিছিল বের করা হয়। ওই।শোক মিছিল আসানসোল মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে গিয়ে শেষ হয়। ওই অনুষ্ঠানে বামপন্থী নেতা পার্থ মুখার্জি, জয়দীপ চ্যাটার্জি, হেমন্ত সরকার, মৈত্রী দাস, ভিক্টর আচার্য সহ বহু বামপন্থী নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

আসানসোল মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কাছে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বামপন্থী নেতারা সীতারাম ইয়াচুরিকে স্মরণ করে বলেন যে তিনি একজন মহান বামপন্থী নেতা ছিলেন। সীতারাম ইয়াচুরি সারাজীবন বামপন্থা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন এবং তিনি তার রাজনৈতিক মূল্যবোধের সাথে কখনো আপস করেননি। বক্তারা বলেন যে সীতারাম ইয়েচুরি যখন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছিলেন, ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার অবসানের পরে, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সামনে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে তার পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। পাশাপাশি বলা হয় যে, সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যু গোটা দেশের বামপন্থী আন্দোলনকে ভীষনভাবে প্রভাবিত করেছে। 

জাতীয় রাজনীতিতে দেশের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে সিপিআই(‌এম) বরাবরই প্রাসঙ্গিক। তবে এই প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখা তুলনায় অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছিল ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম)’র নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট পরাস্ত হওয়ার পরে এবং ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে। সেই পর্বে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)’র একবিংশতিতম কংগ্রেসে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। জাতীয় রাজনীতিতে এক অসম পরিস্থিতিতে ক্ষুরধার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কৌশলকে নিপূণ দক্ষতায় প্রয়োগ করে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি একদিকে হয়ে উঠেছিলেন আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াইয়ের অন্যতম সংগঠক, আরেকদিকে সেই লড়াইয়ে তিনি তীব্রতর করে তুলেছিলেন সিপিআই(এম)’র প্রাসঙ্গিকতাকে।

কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির আগে চার জন সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন পার্টির। তাঁরা হলেন যথাক্রমে কমরেড পি সুন্দরাইয়া, কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, কমরেড হরকিষান সিং সুরজিৎ এবং প্রকাশ কারাত। তাঁরা প্রত্যেকেই দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার লড়াই-সংগ্রামে পার্টির সক্রিয় ভূমিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যের পতাকাকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। অবশ্য বাকি চার জনের তুলনায় তিনি অনেক বেশি কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।

কারণ, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি’র সরকার তৈরি হওয়ার পরে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোটিই ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের মুখে পড়ে। অন্যদিকে, তখন দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে আইনসভায় সদস্যসংখ্যার নিরিখে সিপিআই(‌এম) অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।সেই পরিস্থিতিতে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি দৃপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে বিজেপি-আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং দেশের সর্বস্তরের সাম্প্রদায়িকীকরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সিপিআই(‌এম)’র প্রতিরোধকে লড়াই-সংগ্রামের শিখরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন, জাতীয় রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে একসূত্রে গাঁথার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তাতে সফলও হয়েছেন।

পরপর দু’বার লোকসভায় একক গরিষ্ঠতা পেয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ার সুবাদে ২০২৪ সালের নির্বাচনে যখন বিজেপি-আরএসএস ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্যে বেপরোয়া, সেই সময়ে নানা স্বার্থগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলিকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে তিনি নিরলস ব্যস্ত থেকেছেন এবং একটি ব্যাপকভিত্তিক বিজেপি-বিরোধী মঞ্চকে বাস্তব রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তা পরিণতি পেয়েছে ইন্ডিয়া মঞ্চের আত্মপ্রকাশে। সেই মঞ্চ প্রবল ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি-আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনকে, বিজেপি-কে লোকসভায় একক গরিষ্ঠতা হারাতে বাধ্য করেছে।

কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির জন্ম ১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট, তৎকালীন মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই) এক তেলুগুভাষী পরিবারে। তাঁর বাবা সর্বেশ্বরা ইয়েচুরি পেশায় ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের রাজ্য পরিবহণ সংস্থার ইঞ্জিনিয়ার। মা-ও ছিলেন ওই রাজ্যের পদস্থ সরকারি কর্মচারী। কমরেড ইয়েচুরির স্কুলের পড়াশোনা শুরু হায়দরাবাদের অল সেন্ট হাই স্কুলে। পরে তাঁকে দিল্লিতে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা-বাবা, ভর্তি করা হয় দিল্লির প্রেসিডেন্ট এস্টেট স্কুলে। সেখান থেকেই সিবিএসই দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। এরপর স্নাতক স্তরে তিনি অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে, প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকে উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতকোত্তরের জন্য ভর্তি হন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এ। তাতেও তিনি উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণিতে। ১৯৭৪ সালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন এবং এসএফআই’র নেতা হয়ে ওঠেন। দুই বছরের মধ্যে তিনি তিন বার জেএনইউ’র ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এসএফআই’র সর্বভারতীয় সভাপতি। ওই সময়ে এসএফআই-কে একটি সর্বভারতীয় শক্তি হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এর মধ্যেই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালে তিনি সিপিআই(এম)’র সদস্যপদ অর্জন করেন।

১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বাদশ কংগ্রেস থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন এবং ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেস থেকে তিনি পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিট ব্যুরোর সদস্য। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)’র একবিংশতিতম কংগ্রেসে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হন, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ছিলেন এই পদে। তিনিই পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক, যিনি এই পদে থাকার সময়েই প্রয়াত হলেন। সিপিআই(‌এম)’র ভূমিকাকে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরীরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করার প্রশ্নে তিনি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির খসড়া তৈরি করেছিলেন কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরমের সঙ্গে যৌথভাবে। আবার পার্টির সাংগঠনিক ভূমিকা পালনের পাশাপাশি সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবেও তিনি যুক্ত হন ২০০৫ সালে। ওই বছরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনি নির্বাচিত হন রাজ্যসভায়। দু’টি মেয়াদে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর তিনি বামপন্থী সাংসদ হিসাবে অনবদ্য অবদান রেখেছেন সংসদের ভিতরে। ছিলেন দুর্দান্ত বাগ্মী। বিরোধী পক্ষের সদস্য হিসাবে রাজ্যসভায় বিভিন্ন বিষয়ে ও বিতর্কে তাঁর ভাষণ প্রশংসা পেয়েছে সরকার পক্ষেরও। ২০১৭ সালে তিনি পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ সাংসদের সম্মান। বিশেষত, রাজ্যসভা থেকে তিনি যেদিন অবসর নেন, সেদিন তাঁর ভাষণ সংসদের ইতিহাসে অন্যতম সেরা বক্তব্য বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেদিন তিনি ক্ষমতাসীন বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, ‘‘যদি আমাদের বৈচিত্র্যের উপর ধর্মীয় অভিন্নতা কিংবা ভাষাগত অভিন্নতা অথবা সাংস্কৃতিক অভিন্নতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এই দেশ কখনই একসঙ্গে থাকতে পারবে না। তাহলে দেশটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’’ একথা বোঝাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন এই বছরেই অনুষ্ঠিত সর্বশেষ লেকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দলগুলিকে। কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির ব্যবহার ছিল অমায়িক। ছিলেন রসিক মানুষ। তাই নিজস্ব মতাদ‍‌র্শের রাজনৈতিক পরিসরের বাইরেও তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল।

তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল নানা রাজনীতির বহু ব্যক্তির। রাজনীতির বাইরে খুব পছন্দ করতেন পুরানো দিনের হিন্দি গান শুনতে, পড়তে ভালবাসতেন নানা বিষয়ের বই, আর রাজনীতি সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনা চালিয়ে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিহীনভাবে। আটটি ভাষা জানতেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যর বহু পংক্তি ছিলেন তাঁর কণ্ঠস্থ। বিজেপি-আরএসএস’র রাজনীতিকে আক্রমণ করতে সেগুলি ব্যবহার করতেন তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে। বাস্তবিকই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বামপন্থী সংগ্রামে তিনি ছিলেন এক অবিসংবাদী নেতা। বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ৭২ বছর বয়সে তিনি চিরবিদায় নিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *