বার্নপুর সেল আইএসপির সম্প্রসারণ, ভাঙা হলো ৫ টি কুলিং টাওয়ার
বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে
বেঙ্গল মিরর, বার্নপুর, রাজা বন্দোপাধ্যায়/সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত : রামনবমী রবিবার সকালে ইস্পাত নগরী বার্নপুর সহ গোটা শিল্পাঞ্চল একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী থাকলো। বার্নপুর ইস্কো কারখানা বা সেল আইএসপিতে পূর্ব ঘোষণা মতো ভেঙে ফেলা হলো ৫ টি কুলিং টাওয়ার। নতুন প্ল্যান্ট সম্প্রসারণের জন্য আইএসপির ভেতরে ৫ টি কুলিং টাওয়ার ভেঙে ফেলা হলো বলে, কারখানার মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ভাস্কর কুমার জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এদিন বার্নপুর সেল আইএসপির পাঁচটি আইকনিক কুলিং টাওয়ার ভেঙে ফেলা হয়। ৭০ বছরের পুরনো পাঁচটি হাইপারবোলিক কংক্রিট ন্যাচারাল ড্রাফ্ট কুলিং টাওয়ার। প্রতিটি ৭২ মিটার উঁচু এবং ৩০-৪৮ মিটার ব্যাসের। এদিন সকাল ১২.১৫ মিনিটে ভেঙে ফেলা হয়।




প্রাথমিক ভাঙার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবচেয়ে সাশ্রয়ী পদ্ধতি হল বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে কাঠামোগত ধস নামানো। এর পরে হাইড্রোলিক সরঞ্জাম লাগানো খননকারী যন্ত্র ব্যবহার করে সেকেন্ডারি পার্টের কাজ করা হয়।দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্ফোরক ধ্বংসকারী বিশেষজ্ঞ মেসার্স জেট ডেমোলিশন ( পিটিওয়াই ) লিমিটেডের সহায়তায় মুম্বাইয়ের মেসার্স এডিফাইস ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার সঙ্গে এই কাজের জন্য চুক্তি হয়েছিলো ।আরো বলা হয়েছে, যেহেতু কুলিং টাওয়ারগুলির কোনও কাঠামোগত অঙ্কন পাওয়া যায়নি, তাই মূল ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলি, যেমন রিং বিমের উপরে শেলের পুরুত্বের টেপারিং এবং স্টিল রিইনফোর্সমেন্ট বারগুলির বিশদ স্থান স্থাপনের পরে সরাসরি স্থান তদন্তের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আগে স্থান পরিদর্শন এবং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রাথমিক ভাঙ্গার নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল। ভাঙার স্থান প্রস্তুতির কাজ শুরু করার সময় ও স্থান স্থাপনের পরে প্রকৃত কুলিং টাওয়ারের কাঠামোগত বিবরণ স্থাপনের জন্য অতিরিক্ত তদন্ত করা হয়েছিল। তাই ভাঙ্গার নকশার কিছু দিক উপকারী বা প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হিসাবে সংশোধন করা হয়েছিল।
জানা গেছে, এই টাওয়ারগুলি ১৯৫০ সালে নির্মিত হয়েছিলো, যখন এই কারখানায় ব্লাস্ট ফার্নেস তৈরী করা হয়। সুতরাং এগুলি প্রায় ৭০ বছরের পুরানো।এদিন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পাঁচটি কুলিং টাওয়ারে ব্লাস্টিং বা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পাঁচটি কুলিং টাওয়ার মাটিতে মিশে যায়। এই প্রক্রিয়া চলার সময় যাতে কোন সমস্যা ও আশপাশে ক্ষতি না হয়, তারজন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। এই কাজের জন্য এদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল পর্যন্ত বার্নপুরের রিভারসাইড এলাকার দুটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন বন্ধ রাখা হয়।
প্রসঙ্গতঃ, এই ধরনের কুলিং টাওয়ার ভাঙার জন্য ভারতে কোনও বিশেষজ্ঞ নেই। তাই বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়েছিলো। আগেই বলা হয়েছিলো ৫ টি কুলিং টাওয়ার এমনভাবে ভেঙে ফেলা হবে, যাতে সেগুলির জন্য আশপাশের কোনকিছু না হয়। এমনভাবে একই জায়গায় ভেঙে ফেলা হবে, যাতে আশেপাশের এলাকার কোনও ক্ষতি হবে না। বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছিলেন , এত বড় টাওয়ার ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখতে খুবই রোমাঞ্চকর হবে। এদিন তেমন দৃশ্য দেখাও গেলো।
উল্লেখ্য, এবারের সম্প্রসারণের ফলে বার্নপুর ইস্কো কারখানা বা সেল আইএসপির লক্ষ্যমাত্রা ৭ মিলিয়ন টন হবে। এই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার পরে সেল আইএসপি দেশের অন্যতম বৃহৎ ইস্পাত কারখানার তকমা পাবে। এই পর্যায়ের সম্প্রসারণে ব্যয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা হবে বলে জানা গেছে। এর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ হতে প্রায় ৫ বছর সময় লাগবে। এর পরে বার্নপুরের আমুল পরিবর্তন হবে।
নতুন সম্প্রসারণ থেকে কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন আরো হবে। নতুন প্রজেক্ট আসায় শুধুমাত্র আইএসপির সাথে যুক্ত লোকদের ভবিষ্যতই উন্নত করবে না এমনটা নয়। আসানসোল পুরনিগমের বার্নপুর এলাকা এবং আশেপাশের গ্রামগুলির উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই সম্প্রসারণ। সেল আইএসপির কাছাকাছি বসবাস করা শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাড়বে এবং শহরের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানও বদলে যাবে। শহরের বিন্যাস বদলে যাবে এবং বিশ্বস্তরে বার্নপুর শহরের নিজস্ব একটা পরিচয় উঠে আসবে ।
সেল আইএসপির কুলিং টাওয়ার কি? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, একটি কুলিং টাওয়ার হল একটি বিশেষ তাপ এক্সচেঞ্জার ও পরিবর্তনকারী যন্ত্র । যেখানে বায়ু এবং জলকে জলের তাপমাত্রা কমাতে একে অপরের সাথে সরাসরি যোগাযোগে আনা হয়। ইস্পাত প্ল্যান্টের জন্য কুলিং টাওয়ারের প্রয়োজন হয়। যাতে উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাকালীন উৎপন্ন বর্জ্য তাপ অপসারণ করা যায় ও সরঞ্জামের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহৃত শীতল জলের মাধ্যমে অপারেশনাল দক্ষতা বজায় রাখা যায়।
প্রসঙ্গতঃ, বার্নপুরে স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার ইস্কো স্টিল প্ল্যান্টের এর আগে প্রতি বছর ২.৫ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত ইস্পাত উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো। পরে তা তা বাড়িয়ে ৫ মিলিয়ন টন করা হয়েছিলো। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি, যা একসময় মার্টিন বার্ন গ্রুপের পতাকাবাহী জাহাজ ছিল। ২০০৬ সালে সেলের সাথে বার্নপুর ইস্কো কারখানার সংযুক্তিকরণ হয়। তারপর এর নাম সেল আইএসপি বা ইস্কো স্টিল প্ল্যান্ট হয়। প্রথম পর্যায়ের সম্প্রসারণে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিলো।