আসানসোলের ৩৫০ কোটি টাকা আর্থিক প্রতারণায় গ্রেফতার তহসিন আহমেদকে পাঠানো হলো কোর্টে
বেশি সুদের লোভে ফাঁদে পা কয়েক হাজার মানুষের, টেড্রিং কোম্পানির নামে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
বেঙ্গল মিরর, আসানসোল, রাজা বন্দোপাধ্যায় : * লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর হওয়ার তিনদিন পরে শনিবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার হলো তহসিন আহমেদ। বেশী সুদের লোভে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ। আর সেই ফাঁদে পা দিয়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছিলো। আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ উঠেছিলো পশ্চিম বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের মাইনোরিটি বা সংখ্যালঘু সেলের সদ্য পদ হারানো সহসভাপতি শাকিল আহমেদের ছেলে তহসিন আহমেদের বিরুদ্ধে।













শনিবার সন্ধ্যায় আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশের ডিসিপি ( সেন্ট্রাল) ধ্রুব দাস বলেন, আসানসোল উত্তর থানার ১৯ নং জাতীয় সড়কে চন্দ্রচূড় মন্দিরের কাছ থেকে তহসিন আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসানসোল উত্তর থানার পুলিশের কাছে খবর ছিলো যে, তহসিন আহমেদ ১৯ নং জাতীয় সড়ক ধরে পালানোর চেষ্টা করছে। সেই মতো অভিযান চালিয়ে তাকে এদিন সন্ধ্যায় ধরা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ধৃতকে রবিবার আসানসোল জেলা আদালতে পেশ করে পুলিশ হেফাজতের আবেদন করা হবে। গত ৪/৫ দিন ধরে এই অভিযোগ নিয়ে সরগরম রয়েছে আসানসোল শহর। স্বাভাবিক ভাবেই চরম অস্বস্তিতে রয়েছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এই নিয়ে বিরোধী দল বিজেপি ও কংগ্রেসের আক্রমণ উড়িয়ে দিয়ে গোটা বিষয়টি থেকে দায় ঝেড়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব।
আসানসোল উত্তর থানার রেলপারের জাহাঙ্গীর মহল্লার বাসিন্দা তহসিন আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার ট্রেডিং ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে ১৫ % সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাজার তিনেক মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে আর্থিক প্রতারণা করেছেন। এই তহসিন আহমেদের বাবা শাকিল আহমেদ পশ্চিম বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের জেলা সহ-সভাপতি ছিলেন গত দু’বছর ধরে। গত ১৯ অক্টোবর তাকে সেই পদ থেকে তাকে সরানো হয়েছে। শাকিল আহমেদ বাম আমলে সিপিএম পরিচালিত আসানসোল পুরনিগমে দুবারের কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদ ছিলেন। আর্থিক প্রতারণার শিকার হওয়া লোকজনেরা অভিযোগ করে বলছেন যে, শাকিল আহমেদের পরিচিত ও তহসিন আহমেদের কথায় বিশ্বাস করার পর তারা টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
প্রতারণার শিকার হওয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আসানসোলের মহিশিলা কলোনির বটতলার বাসিন্দা মৌটুসী দত্ত অভিযোগ করে বলেন, আমি ২০২৪ সালের ২৯ মে বেশি সুদের কারণে ৪ লক্ষ টাকা তহসিন আহমেদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করি। তার বিনিময়ে আমাকে মাসে ১৫ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়। তিনি অভিযোগে লিখেছেন পরে ১৯ লক্ষ টাকা চেক এবং ৩৫ লক্ষ টাকা নগদ দেন নিজের গয়না এবং অন্যান্য জিনিস বন্ধক রেখে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি সুদ পেয়েছিলেন। তারপর থেকে আর টাকা তিনি পাননি। তিনি সেই টাকা ২০ অক্টোবর দেবেন বলেছিলেন। সেই মতো টাকা চাইতে এলে তিনি তহসিনের পরিবারের হাতে মারধরের শিকার হন। তাতে তিনি আহত হন। তার জন্য তাকে হাসপাতালে চিকিৎসাও করাতেও হয়। তিনি গোটা বিষয়টি জানিয়ে ২২ অক্টোবর বুধবার আসানসোল উত্তর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার রাতেই তহসিন আহমেদ, শাকিল আহমেদ ও মহসিন আহমেদের নামে আসানসোল উত্তর থানার পুলিশ এফআইআর করে। তিনজনের বিরুদ্ধে বিএনএসের একাধিক ধারায় মামলা করা হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে শাকিল আহমেদের বাড়ির সামনে প্রতারিত হওয়া মানুষেরা জমা হয়ে বিক্ষোভ দেখান। এরা শাকিল আহমেদের ছেলের ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ।
প্রতারণার শিকার হওয়া অবসরপ্রাপ্ত এক বিএসএফ অফিসার বলেছেন, আমিও এইসব লোকদের কথায় বিশ্বাস করে প্রথমে ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। তখন আমি ভালো রিটার্ন বা সুদ পাচ্ছিলাম। তারপর আমি সবকিছু দেখে আরো বিনিয়োগ করি। সবমিলিয়ে আমি ৪১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সুদ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর যখনই আমি তাকে টাকার কথা বলি, তখন সে অজুহাত দেখান। তিনি আরো বলেন, যেহেতু তিনি বিএসএফে কাজ করতাম, তাই অনেকেই আমাকে দেখে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাদের সবার টাকা গেছে। তার দাবি ব্যবসায় তিন হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা এই প্রতারণায় যুক্ত। তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে আসানসোল উত্তর বিধানসভার বিধায়ক তথা রাজ্যের আইন ও শ্রম মন্ত্রী মলয় ঘটকের সাথেও দেখা করেছি। তাকে গোটা বিষয়টি বলেছি। মলয় ঘটক আশ্বাস দিয়েছেন যে মূল টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। ইতিমধ্যেই গোটা বিষয়টি নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা অমিত মালব্য ও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বৃহস্পতিবার নিজেদের টুইটার হ্যান্ডেলে টুইট করেছেন। তাতে তারা দাবি করেছেন, তৃণমূলের নেতা এরসাথে যুক্ত রয়েছেন। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা প্রতারণা করা হয়েছে ৩০০০এর বেশি মানুষের সঙ্গে। তার দাবি, এই অভিযোগের অবিলম্বে সেবি এবং ইডিকে দিয়ে তদন্ত করা হোক । এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও সর্বোপরি যাদের টাকা গেছে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।আসানসোল দক্ষিণ বিধানসভার বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল গোটা বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করার পাশাপাশি রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দলের কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে। জেলা কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের তরফেও আক্রমণ করা হয়েছে শাসক দলকে।


