মর্মান্তিক ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া
সুইসাইড নোট লিখে ১৩ মাসের ছেলেকে খুন করে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী মা



বেঙ্গল মিরর, রাজা বন্দোপাধ্যায়, আসানসোল, ২৪ নভেম্বরঃ ১৩ মাসের ছেলের কানের পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে, জানা যায়, তার কানের সমস্যা রয়েছে। আর তাতেই সব কিছু উলোটপালোট হয়ে যায়। আর সেই রিপোর্টে দিকশূন্য হয়ে পড়েন মা। ছেলের ভবিষ্যত কি হবে এই দোটানায়, শেষ পর্যন্ত ১৩ ছেলেকে শ্বাসরোধ করে খুনের পরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হলো মা। সোমবার গভীর রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে আসানসোলের হিরাপুর থানার বার্ণপুরের রাধানগর রোডে।

মৃত বৈশাখী মাজি আসানসোল দূর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ বা আড্ডার আসানসোল অফিসে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চাকরি করতেন
মঙ্গলবার সকালে এই ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার পরে গোটা এলাকা চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃতদের নাম বৈশাখী মাজি (৩১) ও অন্তরীপ মাজি (১ বছর ১ মাস) । হিরাপুর থানার পুলিশ বৈশাখীদেবীর শোওয়ার ঘর থেকে তারই লেখা একটি সুইসাইড নোট পেয়েছে। মৃত বৈশাখী মাজি আসানসোল দূর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ বা আড্ডার আসানসোল অফিসে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চাকরি করতেন।
বৈশাখীদেবীর স্বামী অনুপম মাজি একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের আধিকারিক হিসাবে বর্তমানে কাটোয়ায় কর্মরত আছেন। সোমবার রাতে তিনি বাড়িতে ছিলেন না। স্ত্রী ও ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি এদিন সকালে ছুটে আসেন কর্মক্ষেত্র থেকে। খবর পেয়ে আসেন আড্ডার চেয়ারম্যান বিধায়ক তাপস বন্দোপাধ্যায়। আসেন এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর মিলন মন্ডল। এদিন বিকালে আসানসোল জেলা হাসপাতালে মা ও ছেলের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়।
রিপোর্ট হাতে পেয়ে চরম হাতাশায় পড়েন বৈশাখী
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হিরাপুর থানার বার্ণপুরের রিভারসাইডের বাসিন্দা বৈশাখী মাজির সঙ্গে দুবছরের আগে বিয়ে হয় রাধানগর রোডের অনুপম মাজির পরে তাদের একটি সন্তান হয়। নাম অন্তরীপ। বর্তমানে যার বয়স ১৩ মাস।
কিন্তু জন্মের পর থেকেই তার কানের সমস্যা দেখা যায়। যা নিয়ে মা বৈশাখী খুবই চিম্তায় ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে তিনি চিকিৎসকের কাছেও যান। সেই চিকিৎসকের কথা মতো অম্তরীপের কানের পরীক্ষা করা হয়। সোমবার রাতে সেই পরীক্ষার রিপোর্ট আসে। তাতেই জানা যায় যে, ১৩ মাসের শিশুর ৯৫ শতাংশের মতো শ্রবণশক্তি নেই। অর্থাৎ সে কানে শুনতে পায়না। সেই রিপোর্ট হাতে পেয়ে চরম হাতাশায় পড়েন বৈশাখী মাজি।

সোমবার তিনি অন্যদিনের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়েন৷ মঙ্গলবার সকালে বৈশাখীদেবী ঘুম থেকে না উঠায় তার শ্বশুর ধর্মদাস মাজি দরজায় ধাক্কা দেন। বেশ কিছুক্ষুন ধাক্কা দেওয়ার পরেও তিনি বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে পুত্রবধূর কোন সাড়া পাননা। তিনি নিজে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টাও করেন বাড়ির অন্য লোকেদের সাহায্যে। এরপর তিনি বৈশাখীদেবীর বাপের বাড়িতে ফোন করেন।
দরজা ভেঙ্গে দেখা যায় বিছানায় অন্তরীপের নিথর দেহ
সেই খবরে বৈশাখীদেবীর ভাই কল্যান মাজি সহ অন্যান্যরা ছুটে আসেন। ততক্ষণে খবর পেয়ে হিরাপুর থানার পুলিশ আসে। এলাকার বাসিন্দারাও ভিড় জমান। এরপর দরজা ভেঙ্গে দেখা যায় বিছানায় অন্তরীপের নিথর দেহ রয়েছে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। আর বৈশাখী সিলিং ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। ঘর থেকে পাওয়া বৈশাখী মাজির লেখা একটি সুইসাইড নোট। তাতে সে লিখেছে, ছেলের এই সমস্যা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছিনা। তার ভবিষ্যৎ কি হবে? তাই চললাম ছেলেকে নিয়ে। আমাদের এই পরিণতির জন্য কেউ দায়ী নয়। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান হয় যে, ছেলের এই শারীরিক সমস্যা মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি মা। তা চরম হতাশা ও মানসিক অবসাদ থেকেই তিনি ছেলেকে বিষ খাইয়ে খুন করে আত্মঘাতী হয়েছেন।
কিন্তু বিকালে ময়নাতদন্তের পরে জানা যায় যে, ১৩ মাসের শিশুর বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়নি। তার মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধের জন্য। মা বৈশাখী মাজি ছেলের মুখে হাত চেপে ধরাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসক পুলিশকে তা জানিয়েও দেন। এদিকে, এই ঘটনায় মাজি পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।
কল্যান মাজি বলেন, বৈশাখী রিপোর্ট পেয়ে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো। আমি ও আমার বাড়ির লোকেরা তাকে বুঝিয়ে ছিলাম। কিছু হবেনা বলেছিলাম। ওর স্বামী ও শ্বশুর সহ শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও ওকে বোঝায়। বুঝতে পারছি না যে, কেন এমন করলো। বৈশাখী মাজির স্বামীও স্ত্রী ও ছেলের মৃত্যু মন থেকে মেনে নিতে পারছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না যে, স্ত্রী কেন এমন করলো।
আসানসোল দূর্গাপুর পুলিশের ডিসিপি (পশ্চিম) বিশ্বজিৎ মাহাতো এদিন বলেন, সুইসাইড নোট থেকে আমাদের অনুমান ছেলের শারীরিক সমস্যার কথা জানার পরে চরম হতাশা ও মানসিক অবসাদ থেকে বৈশাখী মাজি এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। মৃতার বাপের বাড়ির তরফে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করেছে।