Bengali NewsWest Bengal

কোভিড-বিধিতে এবারও রথের রশিতে টান পড়ল না হুগলির মাহেশে

বেঙ্গল মিরর, মাহেশ, (হুগলি), সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত : করোনা পরিস্থিতিতে এবছরও হচ্ছে না মাহেশের রথযাত্রা। এবারও গড়াবে না হুগলির মাহেশের রথের চাকা। সেক্ষেত্রে বিশেষ পূজা অর্চনা সম্পন্ন হবে।এবার মাসির বাড়ি যাবেন না জগন্নাথদেব। তার বদলে নারায়ণ শিলাকে নিয়ে প্রথমে পদব্রজে রথের চারপাশে ঘোরানো হবে। এরপর নিয়ে যাওয়া হবে ১ কিলোমিটার দূরে মাসির বাড়িতে। মন্দির চত্বরে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী মাসির বাড়ি। সেখানেই রাখা হবে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে। সেখানেই হবে নিয়ম মাফিক পুজো।

File photo

এ বছর ৬২৫ বছরে পা দেবে মাহেশের রথযাত্রা। ভারতের দ্বিতীয় ও বাংলার সবচেয়ে পুরনো মাহেশের রথ। এমনটাই অনুমান ইতিহাসবিদদের। এখানের বিগ্রহ বহু প্রাচীন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবও এখানে জগন্নাথ দর্শনে এসেছিসেন। প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার এই রথ আগে কাঠের ছিল। যদিও দীর্ঘ দিন ধরে কাঠের সেই রথ পুজিত হতে হতে ক্ষয় ধরতে শুরু করে। শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সঙ্গে মাহেশের অধিকারী পরিবারের দীর্ঘ দিনের যোগাযোগ। তাঁরা জগন্নাথ মন্দিরের সেবক। তাঁরা ইচ্ছা প্রকাশ করেন নতুন রথ তৈরি করে দেবেন। ১৩৬ বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কাঠের রথ বদলে ফেলা হবে। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কাঠের বদলে রথ হবে লোহার। সেই রথ এখনও যা পুজিত হয়ে আসছে৷
১৩৬ বছরের এই রথ সেই সময় তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। মাহেশের এই রথ পরিচিত নীলাচল নামে। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু একাধিকবার এই রথ যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মাহেশের নাম দেন “নব নীলাচল”। সেই অনুযায়ী মাহেশের রথ পরিচিত নীলাচল রথ নামে।

মন্দিরের প্রধান সেবায়েত সৌমেন অধিকারী জানিয়েছেন, “ঐতিহাসিক এই রথ যাত্রায় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব অবধি যোগদান করেছিলেন। এই রথের প্রতিটি অংশে ইতিহাস জড়িয়ে আছে।” এই রথে প্রতি বছর জগন্নাথ, বলরাম, সুভ্রদা’কে বসানোর পরে একটি বিশেষ পুজো করা হয়। সেই পুজো দামোদর পুজো নামে খ্যাত।এখানে রথ পুজো হয়। তিন তলা এই রথে যেখানে অন্যান্য বছর জগন্নাথ-বলরাম-সুভ্রদা’কে বসানো হয়, এবার সেখানে রথের নীচে একটি ছবি রাখা হয়েছে। সেখানেই সকলে পুজো দিচ্ছেন। তবে রথকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রথের রশিতে টান না পড়লেও পুজোয় কোনও ফাঁক রাখতে চায় না মাহেশের অধিকারী পরিবার। শুধু রথ নয়, বিশেষ দিনে বিশেষ ভোগ নিয়েও মাহেশে ভক্তদের উৎসাহ আছে। রথ যাত্রায় এখানে ভোগ হিসেবে থাকে পোলাও, খিচুড়ি, আলুরদম, ধোঁকার ডালনা, পনীর ও পায়েস। সোজা রথ থেকে উল্টো রথ অবধি প্রতিদিন নানা রকমের পদ রান্না করে দেওয়া হয় জগন্নাথ-বলরাম-সুভ্রদা’কে।
প্রতি বছর এই উপলক্ষে ২ লক্ষর বেশি ভক্তর সমাগম হয়।

কথিত আছে, জগন্নাথদেবের ভক্ত শ্রীচৈতন্য একবার পুরী যাত্রার পথে মাহেশের মন্দির পরিদর্শনে এসেছিলেন। এখানে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন এবং গভীর সমাধিতে চলে যান। তার পর থেকে এই জায়গার নামকরণ হয় নব নীলাচল।

মাহেশের মন্দির এবং বিগ্রহ তৈরি করেছিলেন ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী। কিন্তু, রথযাত্রা উৎসব শুরু করেন শ্রীচৈতন্যর শিষ্য কমলাকর পিপলাই। যিনি পরে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হন। পিপলাই পরিবারের উত্তরসূরীরাই রয়েছেন মন্দিরের তত্ত্বাবধানে।

পুরীর জগন্নাথের ১২ বছর অন্তর হয় নবকলেবর। কিন্তু মাহেশে ৬২৫ বছর ধরে একই বিগ্রহে পুজো হয়ে আসছে। আগে কাঠের রথ থাকলেও, এখন লোহার রথ।

রথযাত্রা চলছে সেই ১৩৯৬ সাল থেকেই। ১৮৮৫ সাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে এখনকার রথটি। ১৫৫ বছর আগে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু কুড়ি হাজার টাকা ব্যয়ে ৫০ ফুট উঁচু ১২৫ টনের রথটি তৈরি করান।
এই রথই এতদিন টানা হয়ে এসেছে। রথযাত্রা উপলক্ষে প্রতিবার মেলা বসে এখানে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাধারানি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।

Leave a Reply