ASANSOL

সাংবাদিক, পর্বতারোহী ও চিকিৎসক ডা: মিলন সেনগুপ্তর স্মরণসভা

বেঙ্গল মিরর, আসানসোল, সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত ;
গত ২৬ শে জুলাই ২০২১ সন্ধ্যা ৬ টা ৪৫ মিনিটে পরলোকগমন করেন আসানসোলের জনপ্রিয় সাংবাদিক, পর্বতারোহী এবং চিকিৎসক ডাঃ মিলন সেনগুপ্ত। রেখে গেলেন তাঁর অগণিত গুণমুগ্ধ, বন্ধু ও স্বজন। অবসান ঘটে একটি উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানের।

ডা: মিলন সেনগুপ্তর স্মরণে তারই প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া পর্বতারোহী সংগঠন “দ্যা পিকার্স” এর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে আসানসোল গড়াই রোড সংলগ্ন ষষ্ঠী নারায়ণগড় স্মৃতি ভবনে একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের সংযোজনা করেন বন্দনা ঘোষ এবং অনুপম রায়। স্মরণসভার শুরু এবং শেষে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনা করেন মন্দিরা চট্টোপাধ্যায় প্রতিহার এবং
বেহালার সুরে অনবদ্য পরিবেশের সৃষ্টি করেন সুনীল প্রতিহার। তার ছবিতে পুষ্পার্ঘ্য ও ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সবাই।


ওই স্মরণসভায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্মৃতিচারণ করেন বিভিন্ন ঘটনার। সেইসব মানুষের মধ্যে ছিলেন স্বনামধন্য আইনজীবী অমিতাভ মুখার্জি, চিকিৎসক ড: অরুণাভ সেনগুপ্ত, পবন গুটগুটিয়া, প্রবীর ধর, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, দ্যা পিকার্স এর প্রেসিডেন্ট এস এন আগরওয়াল, সমাজসেবী ও বিজেপি রাজ্য নেতা কৃষ্ণেন্দু মুখার্জী, প্রাক্তন কাউন্সিলর ববিতা দাস প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন পিকার্স এর সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর গড়াই ছাড়াও বসন্ত সিনহা, বন্দনা ঘোষ, অনুপম রায়, অসীম সরকার, সাথী রায় ছাড়াও পিকার্স এর সমস্ত সদস্য এবং অগণিত মানুষ যাদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগযোগ ছিল শেষদিন পর্যন্ত।

ডা: মিলন সেনগুপ্ত বার্ধক্য জনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন বছর খানেক ধরে, হঠাৎ ই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং একটি বেসরকারী হাসপাতালে সাতদিনের জীবনযুদ্ধ। অতঃপর প্রবল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর অশীতিপর তরুণটি হার মানেন মৃত্যুর কাছে। গতবছর লকডাউনের শুরু থেকেই পিকার্সের ছেলেমেয়েদের, নিজের বন্ধু, বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনোবল উজ্জীবিত রাখার জন্য নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখতেন।


ডা: সেনগুপ্তর জন্ম
১৯৪১ সালের ১৫ই মার্চ অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে । পিতা স্বর্গীয় সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর মরণোত্তর সন্তান ছিলেন তিনি। নয় ভাইবোনের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। পিতৃহারা শিশু দাদা, দিদি ও মায়ের সস্নেহে তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে লাগলেন। অতি শৈশবেই কলকাতায় চলে আসা, ঢাকুরিয়ার স্কুলে ও পরে দীনবন্ধু এ্যান্ড্রুজ কলেজে শিক্ষাগ্রহণ।
ষাটের দশকের প্রথম দিকেই আসানসোলে চলে আসেন জীবিকার সন্ধানে। এলআইসি, ইসকো, দুর্গাপুরে অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন। অসম্ভব স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন বলেই কোনো চাকরীতেই থিতু হননি। শুধুমাত্র সেনরালে শেষপর্যন্ত বহাল ছিলেন। সেনরালের প্রতিষ্ঠাতা ভুজঙ্গ সেনের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন মিলন।


সেনরালে বন্ধ হয়ে যাবার পর বিভিন্ন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, অভিনয়, অনুবাদ, চিত্রাঙ্কন সবকিছুতেই অত্যন্ত দক্ষ ও সাবলীল ছিলেন। ওনার লেখা বেশ কিছু উপন্যাস, ছোটোগল্প, কবিতা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। রাধা, ধারাভি, সুন্দরী কিন্নর তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতাটি ইংরেজী তে অনুবাদও করেছিলেন।
সাংবাদিকতা করেছেন আসানসোলের তৎকালীন দৈনিক পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গ সংবাদে। একান্ত ইচ্ছানুযায়ী শুরু করেছিলেন বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম “আজকের দিনক্ষণ”।
সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছিলেন। “রা” তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাঁর এই বহুমুখী আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। নব্বইয়ের দশকে দূরশিক্ষার মাধ্যমে ডাক্তারী ডিগ্রী অর্জন। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও যথেষ্ট সুনামের সঙ্গেই চিকিৎসা করতেন।

মিলন সেনগুপ্তর জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার পর্বতপ্রেম। ১৯৬৬ তে পর্বতারোহণের শিক্ষা নিয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশের ডব্লিউএইচএমআই, মানালি থেকে। আসানসোলের প্রথম পর্বতারোহণ সংস্থা মাউন্টেন লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ডাঃ মিলন সেনগুপ্ত।


সেসময় সপ্তশৃঙ্গ, উত্তর উজাতির্চে, দক্ষিণ ল্যাম্পাক, শ্রীকান্ত, কামেট শৃঙ্গে সফল অভিযান করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্বপ্নের সন্তান “দ্যা পিকার্স”। তাঁর পরম যত্নে ও আন্তরিক ও কঠোর অভিভাবকত্বে ৩৭ বছর আগের সেই শিশু প্রতিষ্ঠান আজ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, বহু পালক যুক্ত হয়েছে পিকার্সের ঝুলিতে।
তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় ও দৃপ্ত নেতৃত্বে প্রথম সফল অভিযান কালিন্দী, তারপর একে একে কল্যাণেশ্বরী, কালানাগ, সারো টু, বৈহালি উত্তর ও দক্ষিণ এবং আরোও অন্যান্য শৃঙ্গ।
২০১৫ তে তাঁর নেতৃত্বে পাঙ্গেরচুলা অভিযান এবং ২০১৮ তে সি. বি.১০(তারাপাহাড়) অভিযানও সফল হয়েছিল। ২০১৮ তে উনি বেস ক্যাম্প পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
তাঁর পরম আন্তরিকতায় ডাঃ মিলন সেনগুপ্ত যে এক সার্থকনামা পুরুষ তাই পিকার্স ক্লাবকে ধীরে ধীরে এক পারিবারিক মিলনমেলায় পরিণত করে তুলেছিলেন।
তিনি বলতেন পরিবারের সকলে যদি পাহাড়ে চড়ার ভয়কে জয় করতে পারে তবেই সার্থক হবে পর্বতারোহণ।

২০০২ সালে হারিয়েছিলেন যোগ্য সহধর্মিনী কে, রেখে গেলেন পুত্র, পুত্রবধূ ও পৌত্রীকে।

দ্যা পিকর্স এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ডা: মিলন সেনগুপ্ত চলে যাওয়ায় তারা অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন।
তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করেন সবাই এবং তাঁর সস্নেহ আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার অঙ্গীকার করে এগিয়ে যেতে চান তারা।

সমাজের সব স্তরের মানুষের মুখে একই কথার প্রতিফলন রয়েছে যে, খবরের মানুষ ডা: মিলন সেনগুপ্ত আজ নিজেই খবরের কাগজের পাতায় থাকলেও তার আদর্শ রয়ে যাবে শিল্পাঞ্চলের মানুষের মনের মণিকোঠায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *