West Bengal

করোনা মহামারীর কারণে বছর ২ বন্ধ থাকার পরে শ্রীরামপুরের ঐতিহাসিক মাহেশে গড়ালো রথের চাকা

প্রভু জগন্নাথদেবের এক অলৌকিক পবিত্রভূমী সম্পর্কে সেবাইত তমালকৃষ্ণ অধিকারী জানালেন অজানা ইতিহাস

বেঙ্গল মিরর, সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত :হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের ঐতিহাসিক মাহেশ মানেই প্রভু জগন্নাথদেবের এক অলৌকিক পবিত্র ভূমী। মাহেশের রথের চাকায় লেগে রয়েছে শত শত বছরের ইতিহাস। আর সেই পরম্পরা আবহমানকাল থেকে আজও সমানভাবে বয়ে চলেছে। কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ‘ রাধারাণী ‘ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের পটভূমিতে শ্রীরামপুর মাহেশের রথের কথা উল্লেখ করেছেন । যুগ যুগান্তর ধরে এক অলৌকিক অমোঘ আকর্ষণেই মাহেশের রথ এবং মেলা দেখতে অগণিত মানুষ , ধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে প্রতি বছর হাজির হন মনের আনন্দে । এমনকি শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব যখন যুগাবতারে পরিণত হওয়ার আগের সময়কলে বারবার গিয়েছেন মাহেশের রথ দর্শন করতে।

শ্রীরামপুরের ঐতিহাসিক জগন্নাথদেবের মন্দিরের অন্যতম সেবাইত তমালকৃষ্ণ অধিকারী পূর্বপুরুষদের মুখে যে কাহিনি শুনেছেন এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপিতে যতটা বর্ণিত আছে তার কিছুটা বলেন বেঙ্গল মিররের সংবদিককে। সে প্রসঙ্গে পড়ে আসছি। এবারের ৬২৬ বছরে পদার্পণ করেছে রথযাত্রা। ৬২৬ তম বছরে মাহেশের রথ সম্পর্কে তমালবাবু বলেন, ইতিহাসে বিরল ঘটনা যে করোনা মহামারীর কারণে বিগত ২ বছর রথযাত্রা উৎসব হয়নি। এবার তাই ভক্তদের উৎসাহ ছিল দেখবার মত সুশৃঙ্খলভাবেই এবার রথযাত্রা পালিত হচ্ছে।” শ্রীরামপুরের সাংসদ থেকে শুরু করে রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, অভিনেতা ও বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক, বিধায়ক মদন মিত্র, ড: নির্মল মাজি থেকে শুরু করে রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন আধিকারিক পবিত্র স্থানে জগন্নাথ দেবের আশীর্বাদ নিতে এবারে আসেন। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এসেছিলেন এবং তারই নির্দেশে পর্যটন স্থল হিসেবে নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে এই স্থান।”

এবার মাহেশের রথের কিছু ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, জানা যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব অন্তত তিনবার রথের দিন মাহেশে এসেছিলেন । জগন্নাথদেবের যাত্রাপথে রথের সামনে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে ভক্তিনৃত্যেও ঠাকুরকে মেতে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ইংরেজি ১৮৮৫ সালে শেষবার রামকৃষ্ণদেবের মাহেশে আবির্ভাব হয় বলে জানা যায়। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণঠাকুর জর্জরিত কণ্ঠে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত শিষ্যদের রথের দিন বললেন , ” মনটা বড় টানছে রে , চল যাই মাহেশে। জগন্নাথদেবকে দর্শন করে আসি। দেরী না করে বজরা করে গঙ্গায় ভেসে সঙ্গীদের নিয়ে ঠাকুর হাজির হন মাহেশের লক্ষ্মীঘাটে।রথের কাছেই একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন । সেবার আর সারদাদেবী নয় , সঙ্গে ছিলেন গোলাপ মা । তিনিই ঠাকুরের জন্য খিচুড়ি রান্না করলেন । কিন্তু খাদ্য গ্রহণের অবস্থায় ঠাকুর নেই । গলা দিয়ে কিছুই নামছে না । গুরুতর অসুস্থ মানুষটিকে নিয়ে সঙ্গীরা ব্যাকুল। রথের দড়িতে টান পড়ল । চারিদিকে লোকে লোকারণ্য । হঠাৎ এক অলৌকিক প্রাণশক্তি দেখা গেল ঠাকুরের মধ্যে । সবাইকে অবাক করে ঘর থেকে ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে ভিড় ঠেলে রামকৃষ্ণদের এগিয়ে গেলেন । রথের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ” জয় জগন্নাথ” ধ্বনি তুললেন । গলার আওয়াজ খুবই ক্ষীণ । ঠাকুরের এই রূপ দেখে হাজার হাজার ভক্তকূল আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান।

প্রায় ৬২৬ বছর আগে চলতে শুরু করে মাহেশের রথের চাকা । আর তার নেপথ্যে রয়েছে এক অলৌকিক কাহিনী। সর্বত্যাগী সাধক ছিলেন ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী। পরিব্রাজক হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন সময় পুরীতে পৌঁছে তাঁর মনে সাধ জাগল নিজের হাতে ভোগ রেঁধে জগন্নাথদেবকে খাওয়াবেন । কিন্তু পুরীর মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলেন । অন্য সন্ন্যাসীরা তাঁকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিলেন । তাঁদের প্রশ্ন ছিল , “কে অর্বাচীন তুমি , জগন্নাথদেবকে ভোগ খাওয়াবে ??” মনের দুঃখে ধ্রুবানন্দ এসে আশ্রয় নিলেন এক প্রাচীন গাছের তলায় । তাঁর আর বাঁচার ইচ্ছা নেই । অনাহারে থেকে আত্মহত্যা করবেন বলে মনস্থির করলেন । কিন্তু তিন দিনের মধ্যেই স্বয়ং জগন্নাথদের স্বপ্নে এলেন । ধ্রুবানন্দকে স্বপ্নে তিনি নির্দেশ দেন , “ভাগীরথী ধরে মাহেশে পৌঁছে যা । সেখানে মন্দির বানিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠা কর । তারপর ভোগ দিবি । আমি গ্রহণ করব ।”

এভাবেই তিন ভাইবোন অর্থাৎ জগন্নাথ , বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা স্বপ্নাদেশের মাধ্যমেই হয়ে গেল । মাহেশে ভাগীরথী নদীতে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় জগন্নাথদেব এবং তাঁর ভাইবোনের মূর্তি । চৈতন্য মহাপ্রভু এর ৬৫-৬৬ বছর পরে নীলাচলে যাচ্ছেন । নদী পেরিয়ে সপার্ষদ তিনি উঠলেন বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থ ঘাটে । পদব্রজে নীলাচলে যাওয়ার সময় নামলেন শ্রীরামপুরের মাহেশে । ধ্রুবানন্দ মহারাজ তখন মৃত্যুশয্যায় । আত্মহারা চৈতন্যদেবকে দেখে আনন্দে বলে দিলেন , তোমার অপেক্ষায় ছিলাম । মাহেশের রথ তোমার হাতেই তুলে দিলাম । ” এভাবেই জগন্নাথদেবের রথের মাধ্যমে চৈতন্যদেবের দায়িত্বে মাহেশে হল নবনীলাচল । আগে মাহেশের রথ ছিল কাঠের । ১২৯ বছর আগে শ্যামবাজারের দেওয়ান বসু পরিবার দায়িত্ব নেয় । কৃষ্ণচন্দ্র বসুর তত্ত্বাবধানে রথের কাঠামো হয় লোহার । যত দিন যায় , গোটা দেশের মানুষের কাছে মাহেশের আকর্ষণ বাড়তে থাকে । শুধু রথ বা সেই উপলক্ষে একমাসের মেলাই নয় , সারা বছর ধরে নারী পুরুষ নির্বিশেষে জগন্নাথ – দর্শনে আসা – যাওয়া করেন ।

বর্তমানকালে তৃণমূল পরিচালিত সরকার মাহেশের গুরুত্ব বুঝে জায়গাটিকে পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদা দেয় । মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে ২ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করে সেখানে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে । গেট থেকে শুরু করে মন্দিরের সংস্কার মাহেশের সার্বজনীন চেহারাটাই আরও অনেক ঝকমকে হয়ে উঠছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *