আসানসোলে একই সঙ্গে মানবিক ও অমানবিকতার দুই ছবি
জটিল মারণ রোগে আক্রান্তকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নারাজ পরিবার, ঠাঁই জেলা হাসপাতালে
বেঙ্গল মিরর, আসানসোল, দেব ভট্টাচার্য, সৌরদিপ্ত সেনগুপ্ত ও রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ পায়ের পুরনো একটা ক্ষত। যা নিয়েই বাড়ির লোকেরা পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়ার এক ব্যক্তিকে বেশ কিছু দিন আগে আসানসোল জেলা হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন বাড়ির লোকেরা। তারপর তার আর খোঁজ নেওয়ার কথা মনে পড়েননি বাড়ির লোকেদের। এমনকি জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক যখন বলেছেন, যে তিনি অনেকটা ভালো হয়ে গেছেন। তাকে বাড়ির লোকেরা নিয়ে যেতে পারেন। তবু বাড়ির লোক বলেছেন কিছুতেই তাকে তারা ফিরিয়ে নেবেন না। কেননা ঐ রক্ত সংক্রান্ত একটি জটিল মারণ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু ভর্তির সময় অবশ্য হাসপাতাল কতৃপক্ষ ও চিকিৎসককে তারা জানাননি যে ঐ ব্যক্তি এমন একটা রোগে আক্রান্ত। যাকে বাড়ির লোকেরা আর ফিরিয়ে নিতে চায় না। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসক জামুড়িয়া এলাকার জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করেও তাকে বাড়ি ফেরাতে পারেননি। ঐ ব্যক্তিকে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই চিকিৎসা করে চলেছেন জেলা হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জেন ডাঃ নির্ঝর মাজি।
জানা গেছে, প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে জামুরিয়ার একটি এলাকা থেকে বছর ৪৫ ঐ ব্যক্তিকে ডান পায়ে নিচের দিকে একটি ক্ষত বা জখম নিয়ে বাড়ির লোকেরা আসানসোল জেলা হাসপাতালে আনেন। এমারজেন্সি বিভাগ থেকে তাকে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। জেলা হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জেন ডাঃ নির্ঝর মাজি তাকে পরীক্ষা করেন। তিনি সব কিছু দেখে বুঝতে পারেন যদি এই ব্যক্তিকে বাঁচাতে হয় ও শরীরের অন্যান্য অংশগুলোকে ঠিক রাখতে হয়, তাহলে তার ডান পায়ের কিছুটা অংশকে বাদ দিতে হবে। কারণ পায়ের সেই অংশে গ্যাংরিন হয়েছে বা পচন ধরেছে। এরপর তার চিকিৎসা শুরু করেন ডাঃ মাজি। বিভিন্ন প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা করার আগে তিনি জানতে পারেন ঐ ব্যক্তি একটি জটিল ও মারণ রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসক জানতে পারেন, ভর্তি করে দেওয়ার পরের দিন থেকে তার পরিবারের লোকেরা আর তার খোঁজ নিতে আসেনি। চিকিৎসার প্রয়োজনে তার ডান পায়ের একাংশ অ্যাম্পুটেশন করা বা কেটে বাদ দেওয়া হয়। তারপর তাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলা হয় । বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন এবং হাসপাতালেই আছেন।
ঐ ব্যক্তিকে মাঝে মধ্যে দেখতে জামুড়িয়ার এক সমাজকর্মী আসেন জেলা হাসপাতালে। তিনি ঐ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব জানতে পারেন। তার মাধ্যমে ঐ এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান সহ অন্যান্যদের খবর দেওয়া হয় যাতে তার বাড়ির লোকেরা জেলা হাসপাতালে আসেন। এমনকি বিষয়টি জামুড়িয়া থানার পুলিশকেও জানানো হয়। কিন্তু বাড়ির লোকেরা পরিষ্কার জানিয়েছেন তারা তাকে ফেরত নিয়ে যাবেন না।
এই বিষয়ে নির্ঝর মাজি শুক্রবার বলেন, আমি একজন চিকিৎসক হিসাবে চিকিৎসার জন্য যতরকম করা যায় সবটাই করেছি। সেই সঙ্গে আমার যারা সঙ্গে যারা হাসপাতালে কাজ করেন তারাও রোগীর স্বার্থে সব সময় তার দেখভাল ও সাহায্য করে চলেছেন। আমি তার পরিবারের লোকদের সঙ্গেও কথাও বলেছিলাম। তারা পরিষ্কার বলেছেন, তাকে এখানে রাখবেন নাকি অন্য কোথাও ফেলে দেবেন সেটা আপনাদের বিষয়। আমরা তার ঐ রোগ হওয়ায় তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে যেতে পারব না।
জানা গেছে, বাড়ির লোকেরা তাকে নিতে না আসায় ঐ ব্যক্তির মানসিক অবসাদ ও সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেই কারণে শুক্রবার জেলা হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ সৌরভ চট্টোপাধ্যায় ঐ ব্যক্তি পরীক্ষা করেছেন।
এই প্রসঙ্গে জেলা হাসপাতালের সুপার ডাঃ নিখিল চন্দ্র দাস বলেন, ঐ রোগীর চিকিৎসা সব রকম ভাবেই করা হচ্ছে। দেখা যাক কি করা যায়।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ঐ ব্যক্তি রোগ নিয়ে যদি তার পরিবারের এই দৃষ্টিভঙ্গি হয়, তাহলে সামাজিক উন্নয়ন বা সামাজিক শিক্ষার কি মুল্য রইলো? যা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত গর্ববোধ করি।