আসানসোলে কাঠগড়ায় তৃনমুল নেতার ছেলের বিরুদ্ধে ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ বিরোধীদের আক্রমণ, দায় এড়ালো শাসক দল
বেঙ্গল মিরর, আসানসোল, রাজা বন্দোপাধ্যায়ঃ* বেশী সুদের লোভে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ। আর সেউ ফাঁদে পা দিয়ে তিন হাজার মানুষের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ উঠলো পশ্চিম বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের মাইনোরিটি বা সংখ্যালঘু সেলের নেতার ছেলের বিরুদ্ধে। গত তিনদিন ধরে এই অভিযোগ নিয়ে সরগরম আসানসোল শহর। স্বাভাবিক ভাবেই চরম অস্বস্তিতে শাসক দল। এই নিয়ে বিরোধী দল বিজেপির আক্রমণ উড়িয়ে দিয়ে গোটা বিষয়টি থেকে দায় ঝেড়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব। আসানসোল উত্তর থানার রেলপারের জাহাঙ্গীর মহল্লার বাসিন্দা তহসিন আহমেদ নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার ট্রেডিং প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে ১৫ % সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাজার তিনেক মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে আর্থিক প্রতারণা করেছেন।









এই তহসিন আহমেদের বাবা শাকিল আহমেদ পশ্চিম বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের জেলা সহ-সভাপতি ছিলেন গত দু’বছর ধরে। গত ১৯ অক্টোবর তাকে সেই পদ থেকে তাকে সরানো হয়েছে। শাকিল আহমেদ বাম আমলে সিপিএম পরিচালিত আসানসোল পুরনিগমে দুবারের কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদ ছিলেন। আর্থিক প্রতারণার শিকার হওয়া লোকজনেরা অভিযোগ করে বলছেন যে, তহসিন আহমেদের কথায় বিশ্বাস করার পর তারা টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
প্রতারণার শিকার হওয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আসানসোলের মহিশিলা কলোনির বটতলার বাসিন্দা মৌটুসী দত্ত অভিযোগ করে বলেন, আমি ২০২৪ সালের ২৯ মে বেশি সুদের কারণে ৪ লক্ষ টাকা তহসিন আহমেদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করি। তার বিনিময়ে আমাকে মাসে ১৫ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়। তিনি অভিযোগে লিখেছেন পরে ১৯ লক্ষ টাকা চেক এবং ৩৫ লক্ষ টাকা নগদ দেন নিজের গয়না এবং অন্যান্য জিনিস বন্ধক রেখে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি সুদ পেয়েছিলেন। তারপর থেকে আর টাকা তিনি পাননি।
তিনি সেই টাকা ২০ অক্টোবর দেবেন বলেছিলেন। সেই মতো টাকা চাইতে এলে তিনি তহসিনের পরিবারের হাতে মারধরের শিকার হন। তাতে তিনি আহত হন। তার জন্য তাকে হাসপাতালে চিকিৎসাও করাতেও হয়। তিনি গোটা বিষয়টি জানিয়ে আসানসোল উত্তর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার রাতে তহসিন আহমেদ, শাকিল আহমেদ সহ তিনজনের নামে আসানসোল উত্তর থানার পুলিশ এফআইআর করে। তিনজনের বিরুদ্ধে বিএনএসের একাধিক ধারায় মামলা করা হয়েছে। যদিও তিনজনের মধ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বুধবার বিকেলের পরে শাকিল আহমেদের বাড়ির সামনে বিপুল সংখ্যায় মানুষ জমা হয়ে বিক্ষোভ দেখান। যারা শাকিল আহমেদের ছেলের ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ।
প্রতারণার শিকার হওয়া অবসরপ্রাপ্ত এক বিএসএফ অফিসার বলেন, আমিও এইসব লোকদের কথায় বিশ্বাস করে প্রথমে ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। তখন আমি ভালো রিটার্ন বা সুদ পাচ্ছিলাম। তারপর আমি সবকিছু দেখে আরো বিনিয়োগ করি। সবমিলিয়ে আমি ৪১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু এখন সুদ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর যখনই আমি তাকে টাকার কথা বলি, তখন সে অজুহাত দেখান। তিনি আরো বলেন, যেহেতু তিনি বিএসএফে কাজ করতাম, তাই অনেকেই আমাকে দেখে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাদের সবার টাকা গেছে। তার দাবি ব্যবসায় তিন হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা এই প্রতারণায় যুক্ত। তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে আসানসোল উত্তর বিধানসভার বিধায়ক তথা রাজ্যের আইন ও শ্রম মন্ত্রী মলয় ঘটকের সাথেও দেখা করেছি। তাকে গোটা বিষয়টি বলেছি।
গোটা বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বৃহস্পতিবার নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে টুইট করেছেন। তাতে তিনি দাবি করেছেন, তৃণমূলের নেতা এরসাথে যুক্ত রয়েছেন। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা প্রতারণা করা হয়েছে ৩০০০এর বেশি মানুষের সঙ্গে। তার দাবি, এই অভিযোগের অবিলম্বে সেবি এবং ইডিকে দিয়ে তদন্ত করা হোক । এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও সর্বোপরি যাদের টাকা গেছে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। শুভেন্দু অধিকারী তার টুইটে অন্যতম অভিযুক্ত তহসিন আহমেদের একটা ভিডিও বার্তা পোস্ট করেছেন। তাতে তহসিন আহমেদ বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, আমি টাকা নিয়েছি। কিন্তু সেই টাকা ফেরত দিতে পারছি না। তারজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। একইভাবে, গোটা বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা অমিত মালব্য। অন্যদিকে, আসানসোল দক্ষিণের বিধায়িক তথা বিজেপির রাজ্য নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল এদিন সাংবাদিকদের বলেন, আসানসোল উত্তর থানার রেলপারের জাহাঙ্গীর মহল্লার বাসিন্দা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও তার ছেলের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশের কাছে একজন মহিলা অভিযোগ করার পরেও ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেল দোষীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।




এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে গোটা বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে সাংবাদিক সম্মেলন করেন আসানসোল পুরনিগমের বোরো চেয়ারম্যান তথা আসানসোল উত্তর ব্লকের সভাপতি অনিমেষ দাস। সেখানে তিনি বলেন, কয়েক মাস আগেই এই ঘটনা আমরা জানতে পারি। তখনই আমরা তাকে সংখ্যালঘু সেলের সহ-সভাপতি পদ ও দল থেকে ঐ যুবকের বাবা শাকিল আহমেদকে সরানোর জন্য উচ্চ নেতৃত্বর কাছে আবেদন করি। সেই মতো তাকে সরানো হয়েছে। এখন বিরোধীরা এটা নিয়ে অযথা রাজনীতি করছে। আমরা প্রতারিত হওয়া সবাইকে বলছি আপনারা পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করুন। প্রশাসন আপনাদের পাশে থাকবে ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এই সাংবাদিক সম্মেলনে তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের জেলা সভাপতি সৈয়দ মেহেফেজুল হাসান ওরফে মনু সাংবাদিকদের বলেন, শাকিল আহমেদ বামপন্থী বা সিপিএম নেতা হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ। আজও তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। আমি জানতামই না তার ছেলে এইরকম ঘটনা ঘটাচ্ছে।
গত ১৯ অক্টোবর নতুন করে যে জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের সভাপতির নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেই কমিটিতে এখনো কোনো সহ-সভাপতি নেই। তাকে অনেক আগেই এই খবর পাওয়ার পরেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি জেনেছি প্রচুর মানুষ এই ধরনের চিটফান্ডের বেশি লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছিলেন । তিনি আরো বলেন, এর আগে বার্নপুরেও এমন দুটো ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক হবে না। সবার কাছে আমাদের অনুরোধ চিটফান্ডের মতো ব্যবসায় এইভাবে টাকা বিনিয়োগ করবেন না।





