RANIGANJ-JAMURIA

মিশন রানিগঞ্জ ৬ই অক্টোবর মুক্তি পেতে চলেছে, দেখার জন্য খনি শ্রমিক থেকে শুরু করে পড়ুয়ারা উদগ্রীব হয়ে আছে

বেঙ্গল মিরর, দেব ভট্টাচার্য, আসানসোল : ১৯৮৯ এর ১৩ ই নভেম্বর রানীগঞ্জে ভূগর্ভস্থ মহাবীর কোলিয়ারিতে আচমকা দামোদরের জল ঢুকে পড়ে ।সেই সময় খনির ভেতরে ২৩২ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন। ওই জলমগ্ন খনির ভেতর থেকে কোনক্রমে ১৬১ জন উঠে আসেন ।থেকে যায় ৭১ জন। এই ৭১ জনকে উদ্ধার কাজের জন্য মাইনস রেসকিউ দপ্তর নানান পদ্ধতি শুরু করলেও ক্রমশ সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। আর এই অবস্থায় তখন ই সি এল এর অ্যাডিশনাল চিফ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার যশবন্ত সিং গিল নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন । তারই মস্তিষ্কপ্রসূত এক বিশেষ ধরনের ক্যাপসুল ইস্পাত দিয়ে তার টিমের মাধ্যমে তৈরি করান নিজেদের ইসিএল এর সোদপুর ওয়ার্কশপে ।সেই ক্যাপসুল নামিয়ে তিনি তিন দিনের মাথায় প্রথম উদ্ধার করেন একজন অসুস্থ কর্মীকে। তারপর ১৬ই নভেম্বর আরো ৬৪ জন অর্থাৎ মোট ৬৫ জনকে উদ্ধার করে আনেন। ৬ জন মারা গিয়েছিলেন এই দুর্ঘটনায়। ভারতবর্ষের কয়লা খনির ইতিহাসে এত বড় দুর্ঘটনার তিনদিন পরে জীবন্ত অবস্থায় ৬৫ জন শ্রমিককে ক্যাপসুল তৈরি করে উদ্ধার করার জন্যই পরবর্তীকালে তার নাম ক্যাপসুল গিল হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৯১ সালের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটেশ্বর রহমান তাকে সর্বোত্তম জীবন রক্ষা পদক পুরস্কারে সম্মানিত করেন। পাঞ্জাবের অমৃতসরে ২২শে নভেম্বর ১৯৩৯ শ্রী যশোবন্ত সিং গিল জন্মান। ২৬ শে নভেম্বর ২০১৯ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজের জন্মভূমিতেই মারা গেছেন।


এই গিল সাহেবকে স্মরণ করে টিনু সুরেশ দেশাই পরিচালিত মিশন রানীগঞ্জ নামে একটি ছবি করছেন। যে ছবির পোস্টার বুধবারই রিলিজ করা হয়েছে ।সব ঠিকঠাক থাকলে আশা করা যায় আগামী ৬ই অক্টোবর এই ছবিটি মুক্তি পেতে চলেছে। যশবন্ত সিং গিলের চরিত্রে অভিনয় করছেন অক্ষয় কুমার। এই ছবিতেই পরিণীতা চোপড়াও আছেন।
কয়লা খনির সঙ্গে রানীগঞ্জের যোগাযোগ ১৭৭৪ সালে। সেই সময় জন সুমলারব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সঙ্গে দামোদরের পশ্চিম তীরে রানীগঞ্জে প্রথম কয়লা খননে কাজ শুরু হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে রানীগঞ্জের নারায়ণকুরিতে দ্বারকানাথ ঠাকুর কার টেগর এন্ড কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে রানীগঞ্জে প্রথম বাঙালি ব্যবসায়ী হিসেবে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের প্রথম কয়লা প্রাপ্তির জায়গা যে রানীগঞ্জ সেখানেই মহাবীরের মতো কয়লা খনির ভয়ংকর দুর্ঘটনায় ৬৫ জন মানুষকে বাঁচানো হয়েছিল একটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ক্যাপসুল তৈরি করে। আর যিনি এই কাজ করেছিলেন তার স্মৃতিতেই মিশন রানিগঞ্জ ছবিটি তৈরি হল।

এই ছবির শুটিং রানীগঞ্জের নিমচাসহ বিভিন্ন কোলিয়ারি এলাকা, আসানসোল স্টেশন এবং রানীগঞ্জে সেই হাসপাতাল যেখানে দুর্ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানেও শুটিং করা হয়। ছবির একটি বড় অংশের শুটিং লন্ডনের ওয়ার্কশাওরে করা হয়েছে বলেই জানা গেছে। যদিও ছবিটির শুটিংয়ের সময় প্রথম দিকে নাম ক্যাপসুল গিল করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রেই নাম বদলে যে পোস্টার সামনে এসেছে তাতে মিশন রানীগঞ্জ দেওয়া হয়েছে ।প্রায় আড়াইশো বছরের রানীগঞ্জের কয়লা খনির ইতিহাসে কয়লা খনির শ্রমিকের জীবন থেকে বড় দুর্ঘটনায় কিভাবে মানুষকে উদ্ধার করা যায় তা এই প্রথম সেলুলয়েডে এখানে ধরা পড়েছে। আর সেই কারণেই আসানসোল ,রানীগঞ্জ দুর্গাপুর এই খনি শিল্পাঞ্চলের খনি শ্রমিক ,পড়ুয়া থেকে সাধারণ মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছেন ছবিটি দেখার জন্য।


রূপনারায়নপুরের বাসিন্দা এবং খনি এলাকার পরিবারের সাথে যুক্ত অস্মিত রায় বর্মন বর্তমানে ইস্রোতে পড়াশোনার সাথে সাথেই গবেষণার কাজে যুক্ত আছে। অস্মিত বলেন যবে থেকেই ছবির শুটিংয়ের খবর পেয়েছি তবে থেকেই অপেক্ষা করছি প্রথম দিন ছবি রিলিজ হলেও আমি যেখানেই থাকি না কেন এই ছবি দেখব। কেননা এই ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন আমি জন্মাইনি ।বাবা মার মুখে সে গল্প শুনেছি ।স্বাভাবিকভাবেই কিভাবে একজন মানুষ এত মানুষের প্রাণ বাঁচালেন সেই ইতিহাস সেলুলয়েডে উঠে আসবে আমাদের এলাকাতে নিয়ে তা জানতে পারবি কোটি কোটি মানুষ । সিটুর দীর্ঘদিনের কয়লা খনি শ্রমিক আন্দোলনের নেতা সুজিত ভট্টাচার্য বলেন যখন এই ঘটনা ঘটছে তখন সমস্ত উদ্বিগ্ন শ্রমিকদের পাশেই দাঁড়িয়ে আমরা দেখেছি কিভাবে এই ক্যাপসুল দিয়ে কর্মীদের উদ্ধার করার চেষ্টা চলছিল ।এটাই ভারতবর্ষের কয়লা খনি দুর্ঘটনা মধ্যে সবচেয়ে বড় উদ্ধারকাজের নিদর্শন। তাই উঁচিয়ে থাকলাম ছবিটি দেখবার জন্য। রানীগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে কাজ করা বহু আগেই অবসরপ্রাপ্ত খনি শ্রমিক রাম প্রসাদ বলেন আমি দুর্ঘটনার সময় ওখানে ছিলাম না ।কিন্তু পরে সেখানে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। সমস্ত ঘটনাটাই শুনেছি। সেটা যখন সিনেমায় দেখব তখন নিশ্চয়ই গা শিউরে উঠবে । ইসিলির জনসংযোগ দপ্তর থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কর্মী দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন অপেক্ষা করছি ছবি দেখা নিয়ে ।এ নিয়ে লেখালিখিও করেছি ।

তৃণমূলের খনি শ্রমিক সংগঠনের নেতা বিধায়ক হরেরাম সিং বলেন শ্রী গিল যেমন আমাদের কাছে গর্ব তেমন এই ছবিও নিশ্চয়ই আমাদের কাছে গর্ব হবে। এর সঙ্গে রানীগঞ্জ খনি এলাকার নাম জড়িয়ে আছে ।সবার মত অবশ্যই আমিও সুযোগ পেলে ছবিটা দেখবো। ইসিএলের আরেক প্রাক্তন সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদমর্যাদার আধিকারিক রবি শংকর কুন্ডু বলেন যখনি শুটিং চলছিল তখন আগ্রহ নিয়ে দু এক জায়গায় গিয়ে দেখেও এসেছি। এটা অবশ্যই আমাদের কাছে খুব গর্বের বিষয় ।ছবি রিলিজ হলেই দেখব। তবে আসানসোলের কলেজ ছাত্র সুমিত রায় এবং ছাত্রী সৌমিতা দাশগুপ্ত বলেন এই ছবি রিলিজ হলে আসানসোলে আমরা কোন মাল্টিপ্লেক্সে দেখতে পারবো না ।কেননা এখানকার দুটি মাল্টিপ্লেক্সি বন্ধ আছে। তার আগে পুজোর কথা ভেবে যদি মাল্টিপ্লেক্স চালু হয় এই ছবি দিয়ে তাহলে সেটাও কিন্তু মিশন রানীগঞ্জের ক্ষেত্রে একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

Leave a Reply