সাত জার্মান, জগাই একা..
বেঙ্গল মিরর, চরণ মুখার্জী, রানীগঞ্জ : ( Raniganj News ) এক পুলিশের সাহসিকতায় পুলিশের প্রতি আস্থা বেড়েছে কয়লাঞ্চলে। রবিবারের রোমহর্ষক ডাকাতির ঘটনায় ইতিমধ্যেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে খনি অঞ্চল শিল্পাঞ্চল জুড়ে। সোনার দোকানে দুষ্কৃতিদের ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে সোনা লুটপাটের পর, শ্রীপুর ফাঁড়ির পুলিশ আধিকারিক মেঘনাথ মন্ডলের সাথে গুলির লড়াইয়ের ছবি, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তেই পুলিশের প্রতি অনেকেরই চিন্তা ভাবনা পাল্টেছে, রানীগঞ্জ শহরে পরপর তিনটি বড়সড় দুষ্কৃতিমূলক ঘটনায় পুলিশ সফলভাবে দুষ্কৃতকারীদের সাথে লড়াই করে সফলতা পাওয়ায় অনেকেই মনে করছেন পুলিশ প্রশাসন সজাগ ও সচেতন থাকলে অনেকটাই রোখা যাবে দুষ্কৃতি মূলক কাজ। অন্তত কয়ল অঞ্চল শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন মানুষজনের পুলিশ প্রশাসনের সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে এরকমই কথা উঠেছে যে সকলের কাছ থেকে। এবার রাজ্য পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়া ওয়াল থেকে মেঘনাথ মন্ডল এর। প্রশংসা করা হয়েছে
সাত জার্মান, জগাই একা.. সিনেমায় যেমন হয়!
গুলি ছুটছে মুহুর্মুহু। দু’পক্ষেই। এক পক্ষে সাত সাত জন বেপরোয়া রিভলভারধারী। অন্য পক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাত্র একজন। সাত বনাম এক। গুলির লড়াই চলছে রাজপথে, ভরদুপুরে। সিনেমায় যেমন হয়!
ঘটনাটার কথা আপনাদের অনেকেই হয়তো কাগজে পড়েছেন। অথবা টিভিতে দেখেছেন। গত পরশু, অর্থাৎ রবিবারের বারবেলা। ঘড়ির কাঁটা সবে সাড়ে বারোটা ছুঁয়েছে। গমগম করছে রানীগঞ্জ থানার তারবাংলা এলাকার প্রখ্যাত সোনার দোকান। আচমকাই দোকানে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল সাত অজ্ঞাত ব্যক্তি। হেলমেট আর গামছায় ঢাকা মাথা-মুখ, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মুখে হুমকি আর অশ্রাব্য গালিগালাজ। খুব বেশি হলে মিনিট পাঁচেকের অপারেশন, ব্যস। তাতেই দোকান থেকে সাফ চার কোটি টাকার বেশি মূল্যের গয়না। এবার আর কী? সাদা কাপড়ের ব্যাগে পুরে লুটের মাল নিয়ে দুটো বাইকে করে হাওয়া হয়ে যাওয়া।
কিন্তু হাওয়া হয়ে যাওয়া আর হল কই? হতে দিলেন না জামুরিয়া থানার শ্রীপুর পুলিশ আউটপোস্টের ওসি, সাব-ইন্সপেক্টর মেঘনাদ মণ্ডল।
ঘটনাস্থলের থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে আরেকটি দোকানে ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলেন মেঘনাদ। এসেছিলেন সিভিল ড্রেসে, অর্থাৎ সাদা পোশাকে। লোকজনের ভীতসন্ত্রস্ত চোখমুখ এবং ইতস্তত ছোটাছুটি দেখে মেঘনাদ আন্দাজ করে ফেলেন, সোনার দোকানে কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। দোকানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই বের করে ফেলেন কোমরে গোঁজা সার্ভিস রিভলভার, এবং দাঁড়িয়ে পড়েন দোকানের কাছে মাত্র ইঞ্চি ছয়েক চওড়া একটি ইলেকট্রিক পোলের আড়ালে।
ততক্ষণে দোকানের বাইরে পাহারায় থাকা এক ডাকাতও বুঝতে পেরে গেছে, কাজ শেষ করে নিরাপদে পালানো মুশকিল হবে। ভেতরে সঙ্গীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে রিভলভার বের করে সে-ও। এবং একের পর এক গুলিবর্ষণ করতে করতে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে সশস্ত্র ছয় দুষ্কৃতি। যাদের লক্ষ্য করে ইলেকট্রিক পোলের আড়াল থেকে তখন পাল্টা গুলি চালাচ্ছেন অসমসাহসী মেঘনাদ। লিখতে গিয়ে সুকুমার রায়ের লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে অবধারিত, ‘সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে!’ সেই রুদ্ধশ্বাস গুলির লড়াইয়ের ঝলক ধরা রয়েছে সঙ্গের ভিডিওয়।
ডাকাতদের একজনের গায়ে মেঘনাদের চালানো গুলি লাগতেই তারা বোঝে, এবার দ্রুত চম্পট দেওয়া ছাড়া আর গতি নেই। কোনমতে জখম সঙ্গীকে টেনেটুনে বাইকে তুলে, নিজেদের একটি বাইক অকুস্থলেই ফেলে রেখে, ১ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকার সোনা ও হীরের গয়না ব্যাগে পুরে নিয়ে দুটি বাইকে করে পালায় সাতজন। বাইক ছাড়াও ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে জামাকাপড় ভর্তি দুটি ব্যাকপ্যাক, ৪২ রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, এবং ২ কোটি ৪১ লক্ষ টাকার গয়না সমেত একটি ব্যাগ।
‘পালায়’ লিখলাম বটে, কিন্তু ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ মেঘনাদ অত সহজে পালাতে দিলে তো! প্রাণের ঝুঁকিকে থোড়াই কেয়ার করে সোজা বাইকের পিছনে ছুটতে শুরু করেন আমাদের ‘সাতমার পালোয়ান’। বাইক থেকে ততক্ষণে পিছনে ধাওয়া করা মেঘনাদকে লক্ষ্য করে উড়ে আসছে গুলি। সিনেমায় যেমন হয়! তবে বাইকের সঙ্গে ছুটে আর কতক্ষণ পারা যায়? জাতীয় সড়কে শেষমেশ যখন মেঘনাদের নজরের বাইরে চলে যায় বাইক দুটি, ততক্ষণে আশেপাশের সমস্ত নাকা পোস্টে খবর চলে গেছে। খবর চলে গেছে প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড পুলিশের কাছেও।
বাইকে আর বেশিদূর এগোনো যাবে না বুঝে গিয়েছিল ডাকাতরা। আসানসোল-দক্ষিণ থানা এলাকায় চালককে গুলি করে একটি গাড়ি ছিনতাই করে সাতজনের মধ্যে চারজন। গুলিতে সামান্য আহত হন এক পথচারীও, তবে এতেও বিশেষ সুবিধে হয়নি। ঝাড়খণ্ড পুলিশের সহযোগিতায় সেই গাড়ি বাজেয়াপ্ত হয় দ্রুতই। একই সঙ্গে গ্রেফতার হয় গিরিডি জেলার গোপালগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সূরজ সিং। গতকাল বিহারের সিওয়ান এলাকায় আটক হয় গুলিতে জখম সোনু সিং, যে আপাতত ধানবাদের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুই অভিযুক্তের বয়ানের ভিত্তিতে আমাদের জালে খুব শিগগির উঠে আসবে দলের বাকিরা। ছাড়া হবে না কাউকে। যথাসাধ্য দ্রুত উদ্ধার হবে লুটের মালও।
এদিকে মেঘনাদের কী খবর? নির্বিকার ফিরে গেছেন কাজে, যেন কিছুই হয়নি। উভয় পক্ষে প্রায় কুড়ি রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়েছে। খালি হয়ে গেছে তাঁর সার্ভিস রিভলভার। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি, বাইক ভেদ করেছে গুলি। স্রেফ একটি বিদ্যুতের খুঁটিকে ‘মেঘ’ বানিয়ে তার আড়াল থেকে আগাগোড়া লড়ে গেছেন বাস্তবের ‘মেঘনাদ’, জীবনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই। রোমহর্ষক সেই কাহিনি শুনতে চাওয়ার অসংখ্য অনুরোধ আসছে পরিচিতদের কাছ থেকে, আর মেঘনাদ এড়িয়ে যাচ্ছেন অল্প হেসে। অথবা বলছেন, ‘আমি তো স্রেফ ডিউটি করেছি আমার।’
মেঘনাদকে নিয়ে কী আর লেখার? স্যালুট, স্রেফ স্যালুট! ( পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়া ওয়াল থেকে)