ASANSOL

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজ সংস্কারক বিরসা মুন্ডার ১২২ তম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান

বেঙ্গল মিরর, আসানসোল, সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত : স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজ সংস্কারক বিরসা মুন্ডার ১২২ তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে রাজ্য সরকার পক্ষ থেকে জেলা তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার আসানসোলে “কথা হলে” মধ্যাহ্নে একটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও মালা ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ওই অনুষ্ঠানের সূচনা করেন পশ্চিম বর্ধমান জেলাশাসক আইএএস এস অরুণ প্রসাদ, অতিরিক্ত জেলাশাসক ( উন্নয়ন) সঞ্জয় পাল, জেলা প্রকল্প আধিকারিক ও জেলা মঙ্গল আধিকারিক মালবিকা খাটুয়া ছাড়াও রাজ্য সরকারের তথ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে দেবী চন্দন চৌধুরী , তপন কুমার চট্টরাজ ছাড়াও আরো অনেকে।ওই অনুষ্ঠানে ধামসা, মাদল নিয়ে আদিবাসীরা উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।

বীর নেতাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার পর বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এখনও আদিবাসীদের যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সে বিষয়গুলি আদিবাসীদের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন রামলাল টুডু, প্রফেসর দীপক মুদী,কিশোর কোড়া, জনার্দন কোড়া, মতিলাল সোরেন প্রমুখ।
আদিবাসীদের প্রতিনিধিরা বীর নেতা বীরসা মুন্ডার আত্মজীবনী থেকে শুরু করে কিভাবে ধর্মান্তরিত করার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই ও আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন সেই ইতিহাসের কিছু অংশ তুলে ধরেন।

পরবর্তীতে অতিরিক্ত জেলা শাসক (উন্নয়ণ) তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মাধ্যমে আদিবাসীদের অবদান ও বিশেষত বীরসা মুন্ডার আন্দোলনের বিষয়টি তুলে ধরেন। সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুক্ষেত্রে আদিবাসীদের কিছু মানুষ যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হলেও সেগুলি কিভাবে সমাধান করা হচ্ছে সেই বিষয়টিও বলেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংযুক্তা রায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,
বিরসা মুন্ডা ছিলেন একজন মুন্ডা আদিবাসী এবং সমাজ সংস্কারক। ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি আদিবাসী মুন্ডাদের সংগঠিত করে মুন্ডা বিদ্রোহ সূচনা করেছিলেন। ১৫ নভেম্বর ১৮৭৫ সালে তৎকালিন বিহার বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাচির উলিহাতু গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।তার বাবার নাম সুগনা মুন্ডা, মা করমি হাতু।

বিরসা মুন্ডা ব্রিটিশদের দীর্ঘকালের অত্যাচার এবং অধীন থেকে মুন্ডাদের শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য জীবন উৎস্বর্গ করছেন। লক্ষ লক্ষ মুন্ডা তাকে অনুসরণ করে মুক্তির আশা বুকে ধারণ করেছিলেন। ব্রিটিশরা মুন্ডাদেরকে শোষণ করত। মুন্ডাদের সম্পদ লুট করে বিদেশে নিয়ে যেত। তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান রিরসা মুন্ডা। এরপর ছোটনাগপুর অঞ্চলে বিরসা অত্যাচারিত মুন্ডা আদিবাসীদের বিদ্রোহী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

মুন্ডারা একদিকে জমিদার, জোতদার এবং মহাজনদের নিষ্পেশনে শিকার, অন্যদিকে ব্রিটিশরা তাদের সর্বস্ব লুট করতে ব্যস্ত। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে আদিবাসীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৮৯৫ সালে ছোটনাগপুর অঞ্চলে খাদ্যাভাব মহামারীর আকার ধারণ করলে প্রথমবারের মতো বিরসা জমিদার, ভুমিদস্যু, মহাজন এবং ব্রিটিশদের কাছে জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের বকেয়ার জন্য প্রতিবাদী সংগ্রাম শুরু। ১৯০০ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে এই বিদ্রোহী সংগ্রাম।

ঝাড়খন্ডের খুঁটি জেলার উলিহাতু গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম বিরসা মুন্ডার। জার্মান লুথারান মিশন স্কুলে করেন। সেসময় ছোটনাগপুরে নিরক্ষর এবং অজ্ঞ আদিবাসীদের মধ্যে ব্রিটিশদের শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে ওঠেন তিনি।

মাত্র ২০ বছর বয়সে বিরসা মুন্ডা কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং বিভিন্ন অলৌকিক চর্চায় বিশ্বাসী বিভক্ত মুন্ডাদের মধ্যে ঐক্য গড়তে সিং বোঙ্গা পুজার প্রচলন করেন। এর মাধ্যমে তিনি কোচাং, সিনজুরি, লোঙ্গা, কালমার, কাটোই, বীরবাঙ্কী, কুরুঙ্গার মতো বিভিন্ন জঙ্গল এলাকার হাজার হাজার আদিবাসী মানুষদের একত্রিত করেন এবং সবাই বিরসাকে তাদের নেতা নির্বাচিত করেন।

নেতা হিসেবে বিরসার উত্থান জমিদার, মহাজন এবং মিশনারীদেরকে ভীত করে। ফলে তারা বিভিন্ন অভিযোগ এবং চাপ প্রয়োগ করতে থাকে তার বিরুদ্ধে। ১৮৯৫ সালের ২৪শে সেপটেম্বর বিরসা মুন্ডাসহ তার কিছু সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করে সরকার।

২ বছর জেলে খাটার পর মেয়াদ শেষে ১৮৯৭ সালে মুক্তি দেওয়া হয় বিরসাকে। তার মুক্তির পরপরই ছোটনাগপুর এলাকায় গুটিবসন্ত প্রাদুর্ভাবের তৎবধি চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষে ত্রাণ সহায়তার কাজে আত্মনিবেদন বিরসা মুন্ডাকে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। দুর্ভিক্ষ পিড়িত এবং রোগগ্রস্ত মুন্ডারা তাকে নিয়ে মুক্তির নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করে। মুন্ডারা একত্রিত হয় নব উত্থান প্রস্ততির জন্য শুরু হয় উলগুলান, মুক্তির মহাবিদ্রোহ।

১৮৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাচি, সোনপুর, চাইবাসার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে আন্দোলন শুরু হয়। তারপর ব্যাপকভাবে তা ছড়িয়ে পড়ে। এ গণউত্থান ১৯০০ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল। এ আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ সরকার সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। সামরিক বাহিনীকে প্রতিহত করতে হাজার হাজার মুন্ডা তরুণ-তরুণী তীর, ধনুক, বর্শাসহ আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্রশস্ত্র লড়াইয়ে নামে। ব্রিটিশ বাহিনী গুলি চালায়। তীর,ধনুক নিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। ফলে বিদ্রোহী বাহিনী পরাজিত হয়। ব্রিটিশরা নির্বিচারে মুন্ডা নারী ও শিশুদের গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে বিদ্রোহীদের মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। মৃতদেহগুলো রাতারাতি গণকবর দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে বহু আহত বিদ্রোহীকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়।

৩ মার্চ ১৯০০ সালে ব্রিটিশ বাহিনী বিরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে। বিরসা কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, ফাঁসির প্রতিক্রিয়ায় গণঅভুত্থান ঘটতে পারে, এমন সম্ভাবনা থাকায় বিরসা মুন্ডাকে বিষপানে হত্যা করা হয়।
৯ জুন ১৯০০ সালে বিরসা মুন্ডা রাঁচি কারাগারে শহীদ হন।

Leave a Reply